১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঝালকাঠিতে চারবার পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান রসুল। শুধু পিপি নয়, আমুর প্রভাব কাজে লাগিয়ে বিনাভোটে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন ১১ বার।
জজ কোর্টে যেকোনো মামলায় জামিন, আদালতে নিয়োগ- সবই চলত তার ইশারায়। শুধু আদালত বা আইনজীবী সমিতি নয়, এককথায় জেলা পরিষদ, পৌরসভার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি সবই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। কেউ তার কাজের বিরোধিতা করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো। মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পেতেন না আইনজীবীরাও।
আমির হোসেন আমুর পছন্দে হয়েছিলেন জেলা পরিষদের সদস্য। অবৈধভাবে আয় করেছেন অন্তত শতকোটি টাকা। এই টাকায় নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছিলেন বাংলোবাড়ি এবং মাদরাসা। ক্ষমতার প্রভাবে কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের নিজ গ্রাম গোবিন্দধবলের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন আমু নগর।
তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর উল্টে যায় সব কিছু। ছাত্র-জনতা জ্বালিয়ে দেয় শহরের রোনাল্ডসে রোডের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর বাসভবন। আমুর ভবনের পাশেই মান্নান রসুলের বাসা-বাড়িতেও চালানো হয় হামলা। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান রসুল। তার নামে ঝালকাঠি থানায় বিএনপি অফিসে হামলা ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ও দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় ৬টি মামলা দায়ের হয়।
দীর্ঘ সাড়ে সাত মাস আত্মগোপনে থাকার পর গত ১৬ মার্চ ঝালকাঠির আদালতে আত্মসমর্পণ করলে জেলা ও দায়রা জজ আদালত আব্দুল মান্নান রসুলকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। রসুলের আদালতে আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়লে ঝালকাঠির আদালতপাড়ায় কয়েকশ উত্তেজিত জনতা হাজির হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। আদালতপাড়ায় নিয়োগ করা হয় শতাধিক পুলিশ। উত্তেজিত জনতাকে পাশ কাটিয়ে রসুলকে আদালত থেকে কারাগারে নিতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়।
ঝালকাঠির একাধিক আইনজীবী ও ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, আব্দুল মান্নান রসুল (৭৫) ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের গোবিন্দধবল গ্রামের মুজাফফর ভেন্ডারের ছেলে। তাঁর বাবা ঝালকাঠি সদর সাবরেজিস্ট্রার অফিসের ডিড রাইটার ছিলেন। রসুলও তার বাবার সঙ্গে ডিড রাইটারের কাজ করতেন।
১৯৮৫ সালে আব্দুল মান্নান রসুল আইনজীবী হিসেবে ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতিতে তালিকাভুক্ত হন। বসবাস করতেন শহরের রোনালছে রোডে তার বাবার ক্রয় করা বাড়িতে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা আমির হোসেন আমুর সঙ্গে সখ্য গড়তে নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমুকে একটি বাড়ি ক্রয় করিয়ে দেন রসুল।
অভিযোগ রয়েছে, ঝালকাঠি সরকারি কলেজের প্রফেসর সন্তোষ কুমার রায়ের ওই বাড়ি আমুর নামে দলিল করাতে নেওয়া হয় নানা ছলাকলা। আমির হোসেন আমু ওই বাড়িতে নির্মাণ করেন তিনতলা ভবন। ঝালকাঠি এলে আমির হোসেন আমু ওই বাড়িতে বসবাস করতেন। আমির হোসেন আমু এবং আব্দুল মান্নান রসুলের বাড়ির মাঝখানের ওয়াল ভেঙে একটি পকেট গেট তৈরি করা হয়।
ওই গেট দিয়ে যখন-তখন রসুলের পরিবারের লোকজন এবং আমুর পরিবারের লোকজন অবাধে যাতায়াত করত। আমুর দুপুর এবং রাতের খাবার আসত রসুলের বাসা থেকে। এসব ঘটনায় প্রভাব বেড়ে যায় রসুলের। রসুলের বিপক্ষে আমুর সামনে টুঁ-শব্দটিও করতে সাহস পেত না আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমির হোসেন আমু প্রথমে ভূমিমন্ত্রী ও পরে খাদ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আমুর একান্ত পছন্দের লোক আব্দুল মান্নান রসুলকে বানানো হয় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)।
ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির একাধিক সদস্য বলেন, আব্দুল মান্নান রসুল অ্যাডভোকেট হলেও তিনি সাত ধারার মামলাও লিখতে পারতেন না। অথচ আমুর পছন্দের লোক হওয়ায় যোগ্যতাসম্পন্ন অ্যাডভোকেটদের বাদ দিয়ে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পিপির মতো স্পর্শকাতর পদে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে কপাল খুলে যায় আবারও আব্দুল মান্নান রসুলের।
এবারও আমুর পছন্দে তাকে দেওয়া হয় পিপির আসনে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত একটানা চারবার তিনি পিপির পদ আঁকড়ে ছিলেন আমুর অবৈধ প্রভাবে।
ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি এবং জেলা বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে আব্দুল মান্নান রসুল মোট পাঁচবার পিপি ছিলেন। তিনি আমুর হোসেন আমুকে তার পিতা বলে পরিচয় দিয়ে সমাজে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করতেন। আমুর প্রভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন।
২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১ বার জোরপূর্বক আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদ দখল করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিবছর আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের তারিখ এলেই তিনি দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আাইনজীবী সমিতি ঘিরে রাখতেন, যাতে কোনো আইনজীবী নির্বাচনের কোনো পদে নমিনেশন ফরম কিনতে না পারেন। নমিনেশন ফরম কেনার অপরাধে ২০১৩ সালে তিনি আইনজীবী সমিতির বিএনপিপন্থি ১০ জন আইনজীবীর নামে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছিলেন।
শুধু আইনজীবী সমিতির অ্যাডভোকেটদের নামে নয়, আব্দুল মান্নান রসুল যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করে থানার ওসিদের কাছে পাঠাতেন গ্রেপ্তার করার জন্য। পুলিশ রসুলের তালিকা অনুযায়ী বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি করত।
২০১৯ সালে জেলা পরিষদের সদস্য হয়ে রসুল জেলা পরিষদ থেকে কাল্পনিক প্রকল্প তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ক্ষমতার প্রভাবে ঝালকাঠি পৌর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়ে নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে আদালতে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেই তিনি চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে আমুর নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন।
ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মুবিন বলেন, ছোটখাটো বিষয়ে অভিযোগ তৈরি করে রসুল সাহেব ভিন্নমতের আইনজীবীদের শোকজ এবং সদস্যপদ স্থগিত করে আইনজীবীদের পেটে লাথি মারতেন। আবার অনেকের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করতেন।
অবৈধ আয় দিয়ে তিনি গ্রামে বাগানবাড়ি, গরুর খামার এবং ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। ৫ আগস্টের পর তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। আমরা চাই এসব মামলায় তার বিচার হোক। আব্দুল মান্নান রসুলের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মো. হুমায়ুন কবীর বাবুল বলেন, রসুলকে ক্ষমতার নেশায় পেয়েছিল। আমির হোসেন আমুর আশকারায় সে ১১ বার আইনজীবী সমিতির সভাপতি হয়েছে। যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের হয়রানি করেছে।
ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহেব হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের পর আব্দুল মান্নান রসুলের নামে ঝালকাঠি থানায় ৬টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে।
এসব মামলার মধ্যে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, জেলা আইনজীবী সমিতিতে বোমা হামলা ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব ও জেলা আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি শাহাদাৎ হোসেনের ব্যক্তিগত চেম্বার ও বাসা ভাঙচুর, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলা, মহিলা দল নেত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে। মামলাগুলোর বাদী বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। এসব মামলায় তিনি গত সাড়ে সাত মাস পলাতক ছিলেন।