বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫

সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৫, ০২:১৪ এএম

সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলীর  বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিন্ডিকেট গড়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সিআইডিকে নিজের তালুকে পরিণত করেছিলেন সংস্থাটির সাবেক প্রধান ও অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া। তার সিন্ডিকেটের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ উপার্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিকে সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ৭০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে সংস্থাটি। গতকাল সোমবার দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন এসব তথ্য জানিয়েছেন। 

দুদক সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আলী মিয়াকে পট পরিবর্তনের পর বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, দুই বছর সিআইডিপ্রধান থাকাকালে তিনি কোনো নিয়মনীতিকেই পরোয়া করেননি। 

মামলা রুজু, অভিযান, তদন্তের সিদ্ধান্ত থেকে নিষ্পত্তি-সবকিছুই নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক সিআইডিপ্রধান। এবার এই সিন্ডিকেটের বিপুল বিত্ত-বৈভবের সন্ধানে সিআইডি সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে চিঠি দিয়েছে দুদক।
এর আগে গত ১৩ মার্চ সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও তার দুর্নীতিতে সহায়তাকারী পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। তাদের দুর্নীতির অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাজিদ-উর-রোমানকে।

মোহাম্মদ আলী মিয়া ছাড়া বাকি পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন- সিআইডির প্রশাসন শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম, বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মহানগর পশ্চিম) এ কে এম ইমরান ভূঁইয়া, সাইবার ক্রাইমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা, পরিদর্শক মানব শাহাজাদা ও পরিদর্শক মনিরুজ্জামান।

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, মামলা রুজু, অভিযান, তদন্তের সিদ্ধান্ত থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত আইনবহির্ভূতভাবে নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক সিআইডিপ্রধান। তার অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ‘টুঁ’ শব্দ করারও সুযোগ ছিল না। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী মিয়া বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি পুলিশে যোগ দেন। আর ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট সিআইডিপ্রধান হন।

কোনো নিয়মনীতি পরোয়া করতেন না: দুই বছর সিআইডিপ্রধান থাকাকালে তিনি কোনো নিয়মনীতিকেই পরোয়া করেননি। পিছপা হননি বিগত সরকারের ‘প্রেসক্রিপ্টেড’ আজ্ঞা পালনে। বিশেষ করে ওই সরকারের ‘অপছন্দ’ ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে নানা কূটকৌশলে সিআইডিকে ব্যবহার করতেন তিনি। 

এ ছাড়া সিআইডির বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তার অসৌজন্যমূলক আচরণে নানা সময় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করত অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে। শুধু সিআইডিতেই নয়, এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি, মানিকগঞ্জ ও হবিগঞ্জের জেলা পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন পদে থাকাকালেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কম ছিল না। মানিকগঞ্জ ও হবিগঞ্জের এসপি থাকার সময় কনস্টেবল নিয়োগ বাণিজ্য করার অভিযোগ ছিল। 

পুলিশের উচ্চমহল তার এসব অপকর্মের খবর জানত। তবে তৎকালীন সরকারের ‘ঘনিষ্ঠ’ কর্মকর্তা হিসেবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশে তিনি মোহাম্মদ আলী মিয়ার মতো সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা কর্মকর্তা আর দেখেননি। এ ছাড়া তার মতো অর্থলিপ্সু কর্মকর্তা বাহিনীর জন্যই কলঙ্ক ছিল।

পুলিশের একটি শীর্ষ সূত্রমতে, মোহাম্মদ আলী মিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিতেন। আর অবৈধ উপার্জনের অর্থ দিয়ে নিজের ক্ষমতাবলয় সবসময় টিকিয়ে রাখতেন।

অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ আলী মিয়া নিজের সেই সিন্ডিকেটে কতিপয় অধস্তন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও যুক্ত করেন। তাদের দিয়ে কয়েকশ ভুয়া অভিযোগ এনে তদন্ত করার নামে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন।

সিআইডির একটি সূত্র জানায়, মোহাম্মদ আলী মিয়া সিআইডিতে যেসব অন্যায়, অপরাধ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম সরকারি বরাদ্দ মেরে দেওয়া। তার এ কাজে সহযোগী ছিলেন সিআইডির দুজন বিশেষ পুলিশ সুপার আর একজন অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার।

সূত্রটি বলছে, মোহাম্মদ আলী মিয়ার সিন্ডিকেট কাগজে-কলমে সিআইডির বহু কর্মকর্তাকে এককভাবে গাড়ি ব্যবহার দেখাতেন। কিন্তু বাস্তবে বিশেষ পুলিশ সুপার, পুলিশ সুপারদের এককভাবে কোনো গাড়িই দেওয়া হতো না। বরং কয়েকজন কর্মকর্তাকে মিলিয়ে একটি শেয়ারিং গাড়ি দেওয়া হতো। এভাবে এসব গাড়ির জন্য প্রতি মাসে সরকারি বরাদ্দ অর্ধ কোটি টাকা লোপাট করা হতো।

বিপুল সম্পদ: ধরাকে সরাকে জ্ঞান করা সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলেও পুলিশে প্রচলিত আছে। দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, বিরোধী মতের লোকজনকে জিম্মি করে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার ছিল তার অবৈধ অর্থের উৎস। 

দুদকের অনুসন্ধানে মোহাম্মদ আলী মিয়ার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশকিছু জমির তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশি এক ব্যক্তির মালিকানাধীন রিয়েল এস্টেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অংশীদার তিনি। 

লন্ডনে থাকা ছেলে আফনান লাবিব এই ব্যবসা দেখভাল করেন। ঢাকায় মোহাম্মদ আলীর রাজধানীর বাড্ডা মৌজায় আফতাব নগরের কাছে আনন্দনগরে ১২ দশমিক ৩৭ শতক জমির প্লট, মিরপুর বাউনিয়া মৌজায় ৮ দশমিক ২২ শতক জমি, পূর্বাচলে ৫ কাঠা ও কেরানীগঞ্জে ৫ কাঠার প্লট রয়েছে মোহাম্মদ আলীর। এ ছাড়া তিনি অন্যের নামে একাধিক ফ্ল্যাট কিনেছেন।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন: একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে তদন্ত শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক এই সিআইডিপ্রধান। 

সে সময় সিআইডির কয়েকজন কর্মকর্তা এ কাজে তাকে বিরত রাখতে চাইলে তিনি তাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে বলে দাবি করেন। পরে সিআইডির মানিলন্ডারিং শাখায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর চিঠি ইস্যু করেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৭ আগস্ট মোহাম্মদ আলী সিআইডি কার্যালয়ে এসে এ-সংক্রান্ত সব কাগজপত্র সরিয়ে নেন।

সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা: ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও নিজ নামে ৮টি ব্যাংক হিসাবে ৩৩২ কোটি ১১ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ টাকা সন্দেহজনক লেনদেন এবং জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সংগতিবিহীন সম্পদ অর্জনের দায়ে সাবেক চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

এ ছাড়া জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সংগতিবিহীন সম্পদ অর্জনের দায়ে তাঁর স্ত্রী জিনাত পারভীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই মামলায়ও নূর-ই-আলম চৌধুরীকে আসামি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

তিনি জানান, সাবেক চিফ হুইপ ও মাদারীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি নূর-ই-আলম চৌধুরী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসাধু উপায়ে অর্জিত জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে সংগতিবিহীন ৫৭ কোটি ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন করে ভোগদখলে রাখে এবং তাঁর নামে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে ওই প্রতিষ্ঠান এবং নিজ নামে ৮টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৩৩২ কোটি ১১ লাখ ৮০ হাজার ২৪০ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করায় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় একটি মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

এ ছাড়া নূর-ই-আলম চৌধুরীর স্ত্রী জিনাত পারভীন চৌধুরী তাঁর স্বামীর ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং স্বামীর প্রভাব ও আর্থিক সহায়তায় ১৩ কোটি ৮১ লাখ ৬০ হাজার ৩০৯ টাকার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদের মালিকানা অর্জন করে ভোগদখলে রাখায় জিনাত পারভীন চৌধুরী ও তাঁর স্বামী নূর-ই-আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় একটি মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!