ঢাকা নদীবন্দর (সদরঘাট) ও লঞ্চগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথের সবচেয়ে বড় এই বন্দরে চেকিং ছাড়াই যাত্রী প্রবেশ করছে। ঘাটে হকারদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। ছোট নৌকা দিয়ে লঞ্চে যাত্রী তোলা হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষ্যে লঞ্চে অতিরিক্ত স্টাফ নিয়োগের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই করা হয়নি। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এসব ত্রুটির সুযোগ নিয়ে নৌপথে ঈদযাত্রায় নাশকতা চালাতে পারে দুষ্কৃতকারীরা।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, কোস্ট গার্ড, আনসার ভিডিপি, পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএতে পাঠানো হয়েছে। এতে নাশকতা এড়াতে সদরঘাটের প্রবেশপথে আর্চওয়ে স্থাপন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়ানোসহ ১১টি সুপারিশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নাশকতার শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্টের পাঁয়তার করছে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে বিভিন্ন সময়ে খুনি, ছিনতাইকারী, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারী, আন্দোলনকারী ও ডাকাতের বেশে একটি মহল দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। এর অংশ হিসাবে ঈদযাত্রায় বাস, ট্রেন ও লঞ্চগুলোতে নাশকতার টার্গেট করেছে নাশকতাকারীরা।
নাশকতার শঙ্কা :
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সদরঘাট ও লঞ্চের বিভিন্ন স্তরে নিরাপত্তা ঘাটতির তথ্য তুলে ধরে নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সদরঘাটে ২১টি গেট ও ১৮টি গ্যাংওয়ে (পন্টুনে নামার পথ) রয়েছে। এসব গেট ও গ্যাংওয়ে দিয়ে যাত্রী প্রবেশের সময় কোনো ধরনের তল্লাশি বা চেকিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এতে সাধারণ যাত্রীবেশে অনায়াসে টার্মিনালে প্রবেশ করতে পারবে নাশকতাকারীরা। তারা সহজেই ককটেল, বোমাসহ দাহ্য পদার্থ বহন করতে পারে। সদরঘাটে ৫৯টি সিসি ক্যামেরার বেশ কয়েকটি অচল। বেশির ভাগ লঞ্চের ভেতরে সিসি ক্যামেরা নেই। সদরঘাট টার্মিনাল থেকে লঞ্চ ছাড়ার পর ছোট নৌকা দিয়ে যাত্রী তোলা নিষিদ্ধ। কিন্তু ছোট ছোট নৌকা দিয়ে লঞ্চে যাত্রী তোলা হয়। এতে দুর্ঘটনার পাশাপাশি সহজেই নাশকতাকারীরা লঞ্চে উঠে যেতে পারে। লঞ্চের কেবিন ও ডেকের যাত্রীদের এনআইডি কার্ড যাচাই করা হয় না এবং কোনো ডকুমেন্ট বা ছবি তোলা হয় না। এতে সহজেই নাশকতাকারীরা যাত্রীবেশে লঞ্চে অবস্থান করতে পারে। এছাড়া ঈদযাত্রায় প্রতিটি লঞ্চে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ করা হয়। এসব অতিরিক্ত লোকবলের যে কেউ টাকার বিনিময়ে নাশকতায় যুক্ত হতে পারে।
এদিকে, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদরঘাট টার্মিনালের পন্টুনে হকার বসার অনুমতি নেই। অথচ ক্রমান্বয়ে হকারদের আধিক্য বেড়েই চলছে। প্রতিদিন পন্টুনে ৩০০-৩৫০ হকার বসে, যা যাত্রীদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। এটাও নিরাপত্তা হুমকির বড় কারণ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সদরঘাটের আশপাশ এলাকা মীরেরবাগ, মিলব্যারাক, বাবুবাজারসহ আশপাশ এলাকায় অলস লঞ্চ বার্থিং করা থাকে। এসব বার্থিং করা লঞ্চে পর্যাপ্ত স্টাফ ও আনসার সদস্যের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদরঘাটে লেবারদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এখানে প্রায় ৪০০ লেবার রয়েছে। তারা মালামালের চার্জ সরকারি রেটের চেয়ে ১০-১৫ গুণ পর্যন্ত বেশি দাবি করে। এ নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ রয়েছে এবং লেবার ও যাত্রীদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
দুর্ঘটনার ঝুঁকি:
প্রতিবেদনে টার্মিনাল ও লঞ্চে অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও প্রস্তুতি নেই। এছাড়া প্রতিটি লঞ্চে ইঞ্জিন রুমের পাশে গ্যাস সিলিন্ডার বা কেরোসিনের চুলায় রান্না করতে দেখা যায়, যা অগ্নিনিরাপত্তার বড় ঝুঁকি। এছাড়া লঞ্চের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও বয়া নেই। এছাড়া কিছু লঞ্চে বার্দিংয়ের টেকসই রশি নেই। গত ঈদুল ফিতরে তাসরিফ-৪ লঞ্চের রশি ছিঁড়ে পাঁচজন যাত্রী নিহত হয়। এছাড়া লঞ্চের ভেতরে মাদক ও জুয়ার আসর বসে, যা যাত্রীদের বড় নিরাপত্তাঝুঁকির কারণ।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন পেয়েছি। সেখানে কিছু নিরাপত্তাঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে পুলিশ, কোস্ট গার্ডসহ সবাইকে সজাগ থাকতে বলেছি।
তিনি বলেন, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ে ঈদ ব্যবস্থাপনা বৈঠকেও কিছু ঝুঁকির বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। ওই কারণে প্রতিটি লঞ্চে আনসার সদস্য রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন নৌপরিবহণ উপদেষ্টা। বেশির ভাগ লঞ্চ মালিকরা ওই নির্দেশনা মানছেন। নৌপথের কয়েকটি স্পটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কা আছে। ওইসব স্পটে নৌবাহিনী, নৌপুলিশ ও কোস্ট গার্ড টহল দেবে। আমরা আশা করছি, সবার সহযোগিতায় যাত্রীরা নির্বিঘ্নে গন্তব্যে যেতে পারবেন।
নাশকতা রোধে ১১ সুপারিশ:
ঈদযাত্রায় নিরাপত্তা জোরদার করতে ১১টি সুপারিশ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। সুপারিশসমূহ হলো:-
যাত্রী প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য আলাদা গেট নির্ধারণ করে দেওয়া, প্রবেশপথে আর্চওয়ে স্থাপন এবং প্রতিটি গেটে একজন এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে পুলিশ মোতায়েন করতে বলা হয়েছে। যাত্রী প্রবেশের সময়ে ভিডিও করা এবং মালামাল তল্লাশি করা যেতে পারে। কেবিনের যাত্রীদের চাবি বিনিময়ের সময় এনআইডি কার্ড সংগ্রহ ও ছবি তুলে রাখা যেতে পারে। সদরঘাট ও লঞ্চে অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার এবং হকার ও লেবারদের দৌরাত্ম্য কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।