গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় পুলিশ সদস্যদের বরাদ্দ করা আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলির হিসাবে গরমিল পাওয়া গেছে। থানার নিবন্ধন খাতার তথ্যের সঙ্গে মামলার এজাহারে বর্ণিত অস্ত্র ও গুলির তথ্যে এই অমিল রয়েছে। এমনকি অস্ত্র বরাদ্দ করা এবং ব্যবহারকারী সদস্যের নামও ভিন্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ত্র-গুলি বরাদ্দ ও খরচের হিসাবের এই গরমিলে হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের অপরাধ প্রমাণ করা জটিল হবে। কে কোন অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, কার অস্ত্রের গুলিতে প্রাণহানি হয়েছে, এসব প্রমাণ করা সহজ হবে না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৬টি থানায় অস্ত্র ও গুলি ব্যবহারের তথ্যে এ গরমিল পাওয়া গেছে। এগুলো হলো- যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, রামপুরা, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর এবং ভাটারা। জুলাই-আগস্টে যেসব থানা এলাকায় সহিংসতা ও হতাহতের হার বেশি ছিল, সেসব থানার হিসাবেও অমিল বেশি দেখা গেছে।
ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, প্রতিটি ঘটনায় আলাদা তদন্ত চলছে। গুলি যৌক্তিক ছিল কি না? তা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে অস্ত্র বরাদ্দ ও গুলি খরচের অমিল সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
ডিএমপির সদর দপ্তরের একটি সূত্র বলেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি ও অস্ত্র ব্যবহারের তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে এবং কোনো অনিয়ম বা অসংগতি প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডিএমপি জানিয়েছে, থানার একজন পুলিশ সদস্যের নামে যেদিন যে অস্ত্র ও গুলি বরাদ্দ থাকে, তিনি সেদিন সেই অস্ত্র ও গুলি নেন। দায়িত্ব পালন শেষে সেই অস্ত্র ও গুলি থানার অস্ত্রাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দেন। ওই কর্মকর্তা বুঝে পাওয়া অস্ত্র ও গুলির সংখ্যা অস্ত্রাগারের নিবন্ধন (রেজিস্টার) খাতায় লিখে রাখেন। তবে ডিএমপির ছয় থানায় এ নিয়মের বেশি ব্যত্যয় হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে। ব্যবহৃত অস্ত্র ও গুলির তথ্য থানার অস্ত্রাগারের রেজিস্টারে সঠিকভাবে রাখা হয়নি। এমনকি একজনকে একধরনের অস্ত্র বরাদ্দ দেওয়া হলেও তার নামে সেদিন গুলি খরচ বা খারিজ দেখানো হয়েছে অন্য ধরনের অস্ত্রের।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ প্রথম গুলি চালায় ১৭ জুলাই। ৫ আগস্ট পর্যন্ত যাত্রাবাড়ীতে মোট নিহত হন ৫৮ বিক্ষোভকারী, যা রাজধানীর থানাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক।
সূত্র জানায়, ১৯ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাদ্দাম মার্কেট থেকে কুতুবখালী এবং যাত্রাবাড়ী থানার প্রধান ফটক পর্যন্ত ব্যাপক সহিংসতা হয়। ওই ঘটনায় ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তন্ময় মণ্ডল বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানার কয়েকজন এসআই ও এএসআইয়ের নামে চায়নিজ রাইফেলের ৩৩৭টি গুলিসহ বিভিন্ন অস্ত্রের গুলি করার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে নিবন্ধন খাতায় সেদিন যাদের নামে চায়নিজ রাইফেল ও গুলি বরাদ্দের তথ্য রয়েছে, এজাহারে তাদের নাম নেই। আবার নিবন্ধন খাতা অনুযায়ী অস্ত্র বরাদ্দ ছিল একজনের নামে, এজাহারে গুলি খরচ দেখানো হয়েছে আরেকজনের নামে। যেমন এজাহারে এসআই নাদিম মুন্সীর চায়নিজ রাইফেল দিয়ে ৩০টি গুলি করার কথা উল্লেখ আছে। অথচ সেদিন অস্ত্রাগারের নিবন্ধন খাতায় তার নামে শটগান (বাট নম্বর ১০২৪৪) বরাদ্দ থাকার তথ্য রয়েছে। একই দিন এএসআই তানভীর হোসেনের নামে ৩০টি চায়নিজ রাইফেলের গুলি খরচ দেখানো হলেও নিবন্ধন খাতা বলছে, সেদিন তিনি পিস্তল (বাট নম্বর এ-৭৯৭০০৫) ও ৮টি গুলি বরাদ্দ পেয়েছেন। এসআই নুর মোহাম্মদ, ভবতোষ, কামরুজ্জামান, এএসআই সাফায়েত ও হাসান রিয়াজসহ কয়েকজনের নামে চায়নিজ রাইফেল বরাদ্দ ছিল, এজাহারে গুলি খরচে তাদের নাম নেই।
তন্ময় মণ্ডলের নামে নিবন্ধন খাতায় সেদিন কোনো অস্ত্র বরাদ্দের তথ্য না থাকলেও এজাহারে চায়নিজ রাইফেলের ৩০টি গুলি করার দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, তখন (ডিএমপির) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবেই মামলা করা হয়েছে।
জানা যায়, ডিএমপির সহকারী কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাসের নামে ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ী থানার অস্ত্রাগারের নিবন্ধন খাতায় একটি শটগান (বাট নম্বর ১৬৪৯৬৭) ও ৫০টি গুলি, একটি চায়নিজ রাইফেল (বাট নম্বর ৫৮০৫) ও ৫০টি গুলি এবং ২০টি সাউন্ড গ্রেনেড বরাদ্দের উল্লেখ আছে। তবে তার নামে গুলি খরচ নেই।
অবশ্য মধুসূদন দাস বলেন, ‘আমি তখন সচিবালয়ে ছিলাম।’
১৮ থেকে ২১ জুলাইয়ের সহিংসতায় যাত্রাবাড়ী থানায় করা পাঁচটি মামলার বাদী এসআই নাদিম মুন্সি, এসআই তন্ময়, এসআই নওশের, এসআই সাইফুল এবং এসআই এহসানুল হক মোল্লা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাদী আলাপকালে বলেন, ডিএমপির তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে বিভিন্ন মামলায় গুলি খারিজ দেখানো হয়। পরে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এগুলো আবার খারিজ করা হবে বলে তারা (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা) জানিয়েছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এসআই অভিযোগ করেন, গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের আড়াল করতে অন্যদের নামে গুলি খরচ দেখানো হয়েছে। এ নিয়ে তখন কয়েকজন এসআই প্রতিবাদ করলেও ঊর্ধ্বতনদের চাপে তা টিকেনি। তবে এ বিষয়ে কয়েকজন যাত্রাবাড়ী থানায় জিডি করেন। তাদের একজন এসআই নাদিম মুন্সী।
জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, তার করা মামলায় যাদের নামে গুলি খরচ দেখানো হয়েছে, তাদের নামে সেদিন অস্ত্রাগারের নিবন্ধন খাতায় ওসব অস্ত্র ও গুলি ইস্যু ছিল না। তারা গুলিও করেননি।
এসআই শামীম রেজা ২৭ জুলাই করা জিডিতে উল্লেখ করেন, ১৯ ও ২০ জুলাই তার নামে শটগানের ১০টি ও চায়নিজ রাইফেলের ২০টি গুলি খরচ দেখানো হলেও ১৯ জুলাই তার ডিউটি ছিল না, ওইদিন তিনি বাসায় ছিলেন। ২০ জুলাই একটি শটগান (বাট নম্বর ৮২১০) ও ৩০টি গুলি বরাদ্দ ছিল। তবে তিনি থানায় ডিউটি করেন। ডিউটি শেষে অস্ত্রাগারে অস্ত্র ও গুলি জমা দেন। কোনো গুলি করেননি।
সূত্র জানায়, বাড্ডা থানা থেকে ভাটারা থানায় গুলি ও অস্ত্র দেওয়া হলেও সেই গুলি খরচ দেখানো হয়েছে বাড্ডা থানার পুলিশ সদস্যদের নামে। এ বিষয়ে বাড্ডা থানার এসআই শাহ আলমসহ অন্তত ছয়জন পুলিশ সদস্য জিডি করেছেন। জিডিতে তারা অভিযোগ করেছেন, তারা গুলি না করলেও তাদের নামে খরচ দেখানো হয়েছে।
ওই সময় বাড্ডা থানার অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা এসআই জাহিদুল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কথামতো গুলি খরচ দেখানো হয়েছে। এক থানায় ঘাটতি হলে আরেক থানা থেকে অফিস আদেশে নিয়েছে। এগুলো তদন্তে বের হবে।
মোহাম্মদপুর থানাও যেসব পুলিশ সদস্যের নামে গুলি খরচ দেখিয়েছে, তার সঙ্গে অস্ত্র বরাদ্দের তথ্যের মিল নেই। ১৮ জুলাই মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় করা মামলার এজাহারে সেদিন শটগানের ২ হাজারটি ও চায়নিজ রাইফেলের ১২০টি গুলির খরচ দেখানো হয়েছে। থানার ৪০ জন পুলিশ সদস্যের প্রত্যেকের বিপরীতে সমান শটগানের ৫০টি গুলি খরচ দেখানো হয়েছে। এসআই চয়ন সাহার নামে নাইন এমএম পিস্তল ইস্যু থাকলেও চায়নিজ রাইফেলের গুলি খরচ দেখানো হয়েছে। এই মামলার বাদী এসআই আদনান বিন আজাদ।
পুলিশ সূত্র জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ডিএমপির অপরাধ ও ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও থানার অস্ত্রাগার থেকে চায়নিজ রাইফেলের গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড এবং শটগানের গুলি নেন। তবে সেগুলো কারা, কোথায় খরচ করেছেন, সেই হিসাব তারা না দেওয়ায় থানাগুলোতেও কোনো তথ্য নেই।
ডিএমপির সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ওই আন্দোলনের সময় পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের সদস্যরা বিভিন্ন থানা এলাকায় মোতায়েন ছিলেন এবং গুলি শেষ হলে তারা থানার অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করেন। কিন্তু গুলি খরচে তাদের নাম নেই, খরচ দেখানো হয় থানায় কর্মরত সদস্যদের নামে। কিছু পুলিশ সদস্য নিজেকে সরকারের আস্থাভাজন দেখাতে এবং ব্যক্তিগত সুবিধা পেতে নিজের নামে গুলি খরচ দেখানোর চেষ্টা করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণকারীদের আড়াল করতে অন্যদের নামে গুলি খরচ দেখানো হয়েছে। এসব কারণে গুলি খরচের হিসাবে এই গরমিল।
আইনজীবীরা বলছেন, গুলিবর্ষণকারী ব্যক্তির নাম, অস্ত্রের নম্বর এবং গুলির প্রমাণ ছাড়া হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হবে।
আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, যেহেতু অস্ত্র বরাদ্দ এবং গুলি খরচের তথ্য সঠিকভাবে রাখা হয়নি; সুতরাং ব্ল্যাস্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে হত্যার প্রমাণ পাওয়া সম্ভব হবে না।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ জানিয়েছে, গুলি কোথা থেকে এসেছে, তা শনাক্ত করা কঠিন হবে।