ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

সবার প্রতিপক্ষ বিএনপি

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৫, ০১:১৫ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অগ্রভাগে আছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। 

এই তিন দলেরই রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা রয়েছে, সেটি প্রকাশ পাচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমসহ নানা বিষয়ে তাদের অবস্থানের ওপর।  

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতকে। 

সম্প্রতি তাদের রাজনৈতিক কাযক্রম বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য সামনে এসেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পরস্পর পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও বক্তব্য দিচ্ছে দল তিনটি। কিন্তু একটি বিষয়ে তারা ঐকমত্য, সেটি হলো ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন ঠেকানো।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক জানান, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে এনসিপি ও জামায়াতকে। 

তবে তাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য থাকলেও ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসন ঠেকানো নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আছে, যেটা সাধারণ মানুষ মনে করছে। এদিকে দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার প্রাণ ঝরিয়ে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত ও পালিয়ে যাওয়া এই দল যেন আর কখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে না পারে, সে বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি- তিন দলের নেতাদের কণ্ঠেই এক সুর। এমনকি এই প্রশ্নে যেন অটুট থাকা ঐক্য নষ্ট না হয়, সে বিষয়ে দলগুলো সচেষ্ট বলেও নেতারা উল্লেখ করছেন।

আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী এখন বিএনপির আশ্রয়ে: রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে।

তৃণমূল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার, তাদের বিষয়-সম্পত্তি দখল, উচ্ছেদ, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যবহার করে হামলা-মামলা দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। 

সেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনেকে এখন বিএনপির আশ্রয়ে। অতীতের দুঃখ-যন্ত্রণা, অত্যাচার-নিপীড়নের কাহিনি ভুলে গিয়ে একে অপরের মিত্র হয়ে অবস্থান করছে। নির্মম বাস্তবতাই তাদের অনেকটা কাছাকাছি অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি বরাবরই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বী। রাজনৈতিক আধিপত্য, কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-বিরোধ তাদের মধ্যে চলেই আসছে। 

জামায়াত একটি সংগঠিত, সুশৃঙ্খল দল হলেও ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিযোগিতায় জামায়াতকে প্রতিপক্ষ মনে করে না কেউই। যদিও অনেক সময় তারা নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। 

এখন তারা নিয়ন্ত্রক, সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এ পর্যায়ে, এমনকি অদূর ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় যাওয়ার কথা ভাবছে না। 

রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই প্রধান তাদের কাছে। বিএনপির ক্ষেত্রে তা নয়। তারা সামনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রত্যাশা করে। নির্বাচনে জয়লাভ ও ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করতেই বিএনপি পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে হাতে রাখছে।

বিএনপিকে ঠেকাতে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির তৎপরতা: বিএনপিকে ঠেকাতে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির (জাতীয় নাগরিক পার্টি) তৎপরতা এখন অনেকটাই প্রকাশ্যে এসেছে। 

পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে যা যা বলছে, তাও পক্ষান্তরে বিএনপির বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তিন পক্ষই বিএনপিকে টার্গেট করে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।

 উদ্দেশ্য হলো; হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা, নয়তো নির্বাচনের আগে বিএনপির ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিএনপিকে ইঙ্গিত করে এনসিপির তৎপরতা অনেকটা দৃশ্যমান। 

সর্বশেষ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে আগের মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনাগুলো চলছে। অভ্যুত্থানের পর এ ধরনের কর্মকাণ্ড বরদাশত করা হবে না।

 তৃণমূল বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কয়েকটি স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির কিছু কিছু অভিযোগ গণমাধ্যমে বেরিয়েছে।

অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন সময়ে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলেছে। মহান স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়েও বেশ কয়েকবার বিএনপির সঙ্গে তারা বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। 

সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে গত বছরের ৫ আগস্টের পর সাত মাসে বিএনপির হাতে কতজন খুন হয়েছে, তার একটি খতিয়ান বা তালিকা জামায়তের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠনো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতা প্রকাশ্যে এসেছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপির জনপ্রিয়তায় দেশে সবাই ঈর্ষান্বিত। তাই বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াত লাগবে, এনসিপি বা অন্য কেউ লাগবে- এটাই স্বাভাবিক।

 তিনি বলেন, যেমন বড় গাছের ওপর বাতাস বেশি লাগে, ঝড়ের আঘাতও বেশি লাগাটা স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে কেউ যদি আহত হয়, তখন মানুষ বলবে বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। 

ফলে বিএনপির সঙ্গে এখন যারা টক্কর দেবে, তারা লাভবান হবে। সেই সূত্রে তারা বিএনপির সঙ্গে শত্রুতা করছে এবং রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত, খালেদা জিয়ার তত্ত্বাবধানে ও তারেক রহমান পরিচালিত দলটাকে সবাই হিংসা করছে। 

প্রতিহিংসার ফসল হিসেবে বিএনপির পেছনে লেগেছে তারা। বিএনপি এখন বহু দলেরই প্রতিহিংসার শিকার, মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার এবং অভিনব কুৎসার শিকার। অন্য কোনো দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নেই, তাই বিএনপিকে হেয় করা প্রতিপক্ষের একটি রাজনৈতিক টেকনিক।’

অন্যদিকে দেশের বেশ কিছু স্থানে চাঁদাবাজি ও দখলের যেসব কথা উঠেছে, তার বেশির ভাগ অভিযোগের আঙুল বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তুলছে এনসিপি। 

তবে বিএনপি বলছে, এখন নব্য দল, নব্য রাজনীতিবিদ, দুই-একটি পুরোনা দলও চাঁদাবাজি-দখলবাজি করছে  আর বিএনপির নাম দিচ্ছে। 

এসব বিষয়ে বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেছেন, ‘চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ যে বিষয়গুলো সমাজকে ধ্বংস করেছে, তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করেছে, সেই বিষয়গুলো শক্ত হাতে দমন করা হবে।’

এর আগে এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলাম বলেন, কেবল কোনো একটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য যদি নির্বাচন চাপিয়ে দেওয়া হয় সংস্কার ও বিচার ছাড়া, তাহলে তা অবশ্যই মেনে নেওয়া হবে না। 

বিএনপির পাশাপাশি পর্যবেক্ষক মহলও মনে করে, বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে এসব কথা বলা হয়েছে। নাহিদ বলেন, বিগত ১৫-১৬ বছরে যাদের ব্যাংক ব্যালান্স অক্ষুণ্ন ছিল, যারা আপসমূলে বিরোধী রাজনীতি করেছে, তাদের কাছে হয়তো ৫ আগস্টকে স্বাধীনতা মনে হয় না।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। আর জামায়াত সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চায়। 

জামায়াতের সঙ্গে আমাদের আর্দশ ভিন্ন।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে মূলত মতপার্থক্য রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে। অনেক বিষয়ে তারা আপত্তি জানিয়েছে এবং সব দিকে দিয়ে বাধা দিচ্ছে। তাই তাদের সঙ্গে বাদানুবাদ হচ্ছে।’

এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে এমন বক্তব্যে জনমনে ধোঁয়াশা তৈরি করছে অন্তর্বর্তী সরকার। জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিএনপিকে ঠেকাতে।

এদিকে গত কয়েক মাসের বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলো দ্রুততম সময়ে ন্যূনতম সংস্কার শেষে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। 

তবে সবচেয়ে বড় মিত্র জামায়াত ‘আগে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার, পরে নির্বাচন’ এবং আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে। পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য প্রার্থীও ঘোষণা করে চলেছে জামায়াত।

জানা যায়, মূলত জামায়াত নিজেদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতেই ব্যাপক সংস্কারের কথা বলছে। তা ছাড়া নির্বাচন দেরিতে হলে বিভিন্ন অভিযোগে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে এবং নির্বাচনে জামায়াত লাভবান হবে বলে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে। কেউ কেউ মনে করেন, এমন কৌশল থেকেই নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে দলটি।

তবে এসব বিষয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সংস্কার ছাড়া কোনো নির্বাচন আয়োজনকে সমর্থন করবে না দলটি। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার জরুরি সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচন চান তারা। এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান তারা। 

এর আগে গত ২০ জানুয়ারি দেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নানা খাতের সংস্কারের আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করলে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে অভিমত দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। 

যদিও বিএনপি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে। এ ছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন নেতারা। সবশেষ ২৬ মার্চের আলোচনায় সভায় গোলাম পরওয়ার বলেন, ’৭১ বিষয়ে শেখ মুজিবের সময়েই মীমাংসা হয়েছে, ক্ষমতার লোভে চেতনাবাজেরা মীমাংসিত বিষয় নতুন করে টানতে চায়। 

জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধকে সব সময় ধারণ করে। অবশ্য এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী বলেছিলেন, জামায়াত সব সময়ই বিএনপিকে পেছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করেছে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এসব বিষয়ে বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অনুরাগ বা অভিযোগ নেই। রাজনৈতিক অন্য দলগুলোর সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রয়েছে, বিএনপির সঙ্গেও তেমন সম্পর্ক রয়েছে। নির্বাচনে সমীকরণ কী হবে সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।’

এসব বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, ‘বর্তমানে সবাই সবাইকে ঠেকাতে ব্যস্ত। জামায়াত ও এনসিপিকে ঠেকাতে চাইছে বিএনপি। আবার জামায়াত ঠেকাতে চাইছে বিএনপি ও এনসিপিকে। 

অন্যদিকে, এনসিপি চাইছে বিএনপি ও জামায়াতকে ঠেকাতে।’ বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, এটা স্বাভাবিক, সবার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলছে। তবে দেখার বিষয়, আগামী নির্বাচনে তাদের মধ্যে কোনো সমঝোতা বা রাজনৈতিক মোর্চা হয় কি না। অবশ্য অনৈক্য বা সংকট তৈরি হলে তা দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষতিকর হবে।