ঢাকা শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠছে আরেক বাংলাদেশ

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২৫, ১১:৩৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের বুকে একের পর এক নতুন ভূমি জেগে উঠছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা এই ভূখণ্ড দেশের মানচিত্রে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা। কখনো বন, কখনো খামার, আবার কোথাও গড়ে উঠছে পুনর্বাসন কেন্দ্র বা পর্যটনকেন্দ্র। নতুন এই ভৌগোলিক সংযোজন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় এনে দিচ্ছে নতুন আশাবাদ।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত চার দশকে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অন্তত ১০ লাখ হেক্টর বা ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার নতুন ভূমি জেগে উঠেছে। ক্রসড্যাম ও বনায়নের চলমান প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে আরও ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি সীমানায় যুক্ত হতে পারে।

নোয়াখালী জেলার চরনাঙ্গুলিয়া, উড়িরচর, নিঝুম দ্বীপ, চরকবিরা, চরআলীম, সাগরিয়া, নিউ ডালচর, কেরিংচরসহ বহু চর ও দ্বীপ ইতোমধ্যে বসবাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। কক্সবাজার থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে জেগে ওঠা ভূমি সুন্দরবনের আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন বনভূমি ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ বর্গকিলোমিটার ভূমি সাগরের বুক থেকে উঠে আসছে। যদিও নদীভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে গড়ে ৮ বর্গকিলোমিটার ভূমি, তবুও যোগ-বিয়োগের হিসেবে প্রকৃতি বাংলাদেশের পক্ষেই ভারসাম্য রাখছে। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্রের পলি জমে এভাবেই নতুন ভূমির জন্ম দিচ্ছে, যা দেশের ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক চেহারায় আমূল পরিবর্তন আনছে।

সরকার ইতোমধ্যে ‘উড়িরচর-নোয়াখালী ক্রস ড্যাম নির্মাণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ভূমি পুনরুদ্ধার করে নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উড়িরচরের সংযোগ স্থাপন করা হবে। এতে ব্যয় হচ্ছে ৫৮৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ক্রস ড্যাম ও টাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে স্থানীয়দের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বাড়বে কৃষি উৎপাদন এবং নিশ্চিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা।

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সাগরের বুকে জেগে ওঠা ভূমি বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনার নাম। আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এই চরের মান অনেক উন্নত হবে, যা শিল্প, আবাসন ও পর্যটনের নতুন ভিত্তি গড়বে।’

ভূমি মন্ত্রণালয় নতুন এই ভূখণ্ডকে বাংলাদেশের সীমানায় অন্তর্ভুক্ত করতে কাজ শুরু করেছে। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হচ্ছে ‘কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন’। ইতোমধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও শ্রেণিকরণ নিয়ে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিস (CEGIS), সিডিএসপি, ইডিপি, ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংসহ এক ডজন সংস্থা এই ভূমিগুলোর ফিজিবিলিটি স্টাডি করে সরকারের পরিকল্পনায় সহায়তা করছে।

নতুন ভূখণ্ড টেকসই করতে প্রথমেই সেখানে বনায়নের কাজ শুরু করে বন বিভাগ। কেওড়া, বাইন, করমচা, পুনাইলসহ বিভিন্ন গাছের চারা রোপণ করে নরম মাটিকে শক্ত করে বসবাসযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। এক সময় এই ভূমিগুলোতে কৃষিকাজ, গবাদি পশুপালন ও পর্যটনের মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব হবে।

সমুদ্র হবে বাংলাদেশের সম্পদ। নতুন জেগে ওঠা ভূমিগুলো ভবিষ্যতে দেশের শিল্প, কৃষি ও আবাসনের বড় ভিত্তি হবে। নতুন ভূমিকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার করা গেলে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করতে পারবে।

বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে জেগে ওঠা এই ভূমি বদলে দিচ্ছে দেশের ভৌগোলিক গঠন, অর্থনীতির চেহারা এবং মানুষজনের জীবনের গল্প। প্রকৃতির দেওয়া এই উপহারকে সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে আরও সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল ও দুর্যোগ-সহনশীল।