পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বরফশীতল থাকা বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক এখন এক নতুন মোড় নিতে চলেছে। ১৯৭১ সালের ইতিহাস আর নানা রাজনৈতিক জটিলতায় সীমাবদ্ধ এই সম্পর্ক যেন অবশেষে বরফ গলানোর পথে হাঁটছে। কূটনৈতিক অচলাবস্থার পর দীর্ঘদিন ধরে স্থবির থাকা সংলাপ আবারও সক্রিয় হচ্ছে এবং তা দুই দেশের জনগণের মাঝে নতুন করে আশার সঞ্চার করছে।
আগামী সপ্তাহে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমেনা বেলুচ ঢাকা সফরে আসছেন, এবং প্রায় ১৪ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি)। সর্বশেষ এই সংলাপ হয়েছিল ২০১০ সালে ইসলামাবাদে।
এবার ঢাকা পর্বে দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
যৌথ উদ্যোগে সম্পর্ক পুনর্গঠনের সম্ভাবনা
এই নতুন রাজনৈতিক আবহে পাকিস্তান প্রস্তাব করেছে যৌথ কমিশন পুনঃগঠন, যার মাধ্যমে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও কাঠামোগত ও ফলপ্রসূ করা যাবে। আলোচনা ঘিরে রয়েছে বাণিজ্যিক সহযোগিতা, ভিসা প্রক্রিয়ায় সহজীকরণ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানোর মতো বিষয়ও।
পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার-এর আসন্ন ঢাকা সফরকে অনেকেই দেখছেন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের একটি প্রতীকী ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ হিসেবে। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তার সফর হতে পারে ২২ থেকে ২৪ এপ্রিলের মধ্যে। সফরের সময় নতুন কিছু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনাও রয়েছে।
বাণিজ্যিক সম্পর্ক: অতীত পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে
বর্তমানে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সম্পর্ক উষ্ণ হলে এবং বাণিজ্যিক বাধাগুলো দূর হলে এই অঙ্ক ৩ বিলিয়ন ডলারেও পৌঁছাতে পারে। ইতিমধ্যেই করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সরাসরি কন্টেইনার জাহাজ আসা শুরু হয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগের ক্ষেত্রে বড় একটি মাইলফলক।
এ ছাড়া, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে উভয় দেশের জন্য, এবং ব্যবসা ও শিক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য গঠিত হতে যাচ্ছে যৌথ বাণিজ্যিক কাউন্সিল।
ইতিহাসের ছায়া পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের পেছনে যে বড় ছায়াটি রয়েছে, সেটি হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও তার ঘাত-প্রতিঘাত। যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আজও আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেনি পাকিস্তান। তবে বিগত কয়েক বছরে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতারা একাধিকবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন, যদিও অনেক বিশ্লেষকের মতে, পূর্ণাঙ্গ ক্ষমা ছাড়া ঐতিহাসিক আস্থা গড়ে তোলা কঠিন।
২০১২ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খারের ঢাকা সফরের পর কিছুটা উষ্ণতা ফিরেছিল সম্পর্কের মাঝে। সেই ধারাবাহিকতায়, সম্প্রতি জাতিসংঘের সাইডলাইনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর মধ্যকার সৌজন্য বৈঠকও এই ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত দিয়েছে।
সামাজিক ও কূটনৈতিক মাত্রায় পরিবর্তনের সূচনা
এই সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং এটি ছুঁয়ে যাচ্ছে দুই দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ, স্মৃতি ও সম্ভাবনাকেও। অনেক বছর ধরে পরিবারবিচ্ছিন্ন মানুষ, যৌথ ব্যবসার স্বপ্ন দেখা উদ্যোক্তা কিংবা সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের প্রত্যাশায় থাকা শিল্পীরা এই পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করে ছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে হলেও ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। আস্থা, কূটনীতি আর মানুষের সংযোগ- এই তিনটি চাবিকাঠি দিয়েই সম্পর্কের নতুন অধ্যায় লেখা যেতে পারে।’
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক এক দীর্ঘ ইতিহাস, বহু না বলা গল্প এবং অসংখ্য সম্ভাবনার সমন্বয়। ৫৪ বছর পর সেই ইতিহাস নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে- তবু অনেক প্রশ্ন এখনো উত্তরহীন। এই মোড় বদলের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে: অতীতকে স্বীকার করা, আস্থা তৈরি করা এবং ভবিষ্যতের জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়া।