শীতকালে গরম গরম পিঠার সঙ্গে গুড়ের মিষ্টি স্বাদ, কিংবা এক কাপ চায়ে চিনির বদলে এক চিমটি গুড়! ভাবতেই কেমন মনটা ভালো ভালো লাগছে না?
বাঙালির জীবনযাপনে গুড় যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে গুড় শুধু স্বাদের জন্যই নয়, এর রয়েছে নানা স্বাস্থ্যগুণও। বিশেষ করে আখের গুড় প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ায় এটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
আজ আমরা জানব আখের গুড়ের উপকারিতা, অপকারিতা, এ গুড় তৈরির পদ্ধতি, এবং আরও কিছু চমকপ্রদ তথ্য যা জানলে আপনিও অবাক হবেন!
আখের গুড়ের উপকারিতা
শক্তির প্রাকৃতিক উৎস: গুড় ধীরে ধীরে হজম হয়, ফলে শরীরে দীর্ঘস্থায়ী শক্তি দেয়। তাই এটি খেলাধুলা বা পরিশ্রমের পরপর খাওয়ার জন্য আদর্শ।
হজমে সহায়ক: ভোজনের পর এক টুকরো গুড় খেলে হজমে সাহায্য করে। এটি পাকস্থলীতে হজমকারী এনজাইমের নিঃসরণ বাড়ায়।
রক্ত পরিশোধন: গুড় রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং লিভারের বিষাক্ত পদার্থ দূর করে দেয়।
রক্তশূন্যতায় উপকারী: গুড়ে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে, যা অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দূর করতে সহায়ক।
সর্দি-কাশি ও শীতজনিত সমস্যা কমায়: শীতকালে গুড় খেলে গলা ব্যথা, ঠান্ডা ও কাশির সমস্যা কমে। গরম দুধে গুড় মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়।
ত্বকের জন্য ভালো: গুড়ের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং মিনারেলস ত্বকের কোষকে রক্ষা করে, বয়সের ছাপ কমাতে সাহায্য করে।
হাড়ের গঠনে সাহায্য করে: গুড়ে থাকা ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ফসফরাস হাড়কে মজবুত রাখে।
আখের গুড়ের কিছু অপকারিতা
যদিও এটি চিনির তুলনায় অনেক ভালো, তবে অতিরিক্ত কোন কিছুই যেমন ভাল না, তেমনি অতিরিক্ত আখের গুড় খাওয়ারও কিছু ঝুঁকিও আছে:
# রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ায়: ডায়াবেটিস রোগীরা এটি খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
# ক্যালরিযুক্ত: গুড়ে ক্যালোরি বেশি, অতিরিক্ত খেলে ওজন বৃদ্ধি হতে পারে।
# সংরক্ষণের সময় ছাঁচ বা ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে: দীর্ঘদিন সংরক্ষিত গুড় খাওয়ার সময় সতর্ক থাকুন।
গুড় তৈরির প্রক্রিয়া (প্রাকৃতিক ও গ্রাম্য পদ্ধতি)
আখ চূর্ণন: সাবধানে নির্বাচিত আখ মেশিনে চাপ দিয়ে রস বের করা হয়।
রস ছাঁকা: আখের রস ফিল্টার করে ময়লা দূর করা হয়।
ফুটিয়ে জ্বাল: রসকে বড় হাঁড়িতে (ডেগচি) রেখে ৫-৬ ঘণ্টা ধরে জ্বাল দেওয়া হয়। এতে রস ঘন হয়ে আসতে থাকে।
গুঁড়ো হওয়া: রস যখন যথেষ্ট ঘন ও আঠালো হয়, তখন তা ঠান্ডা করে ঢালায় ঢেলে রাখা হয়। এরপর তা শক্ত হয়ে গুড়ের রূপ নেয়।
কোনও কেমিক্যাল নয়: খাঁটি গুড়ে কোনও রঙ বা সংরক্ষণকারী যোগ করা হয় না। একে বলা হয় ‘দেশি গুড়’ বা ‘অর্গানিক গুড়’।
গুড় চেনার সহজ উপায়:
# রঙ গাঢ় বাদামি বা হালকা সোনালি
# ঘ্রাণ মিষ্টি ও প্রাকৃতিক
# হাতে নেওয়ার পর যদি আঠালো না লাগে, তবে সেটি খাঁটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি
# পানি দিলে নিচে তলিয়ে যায়- এটি আসল গুড়ের লক্ষণ
গুড় দিয়ে তৈরি কিছু জনপ্রিয় খাবার:
গুড় দিয়ে তৈরি অনেক জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাবার রয়েছে, যেগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। পাটিসাপটা পিঠা হলো একটি মিষ্টি পিঠা, যা নারকেল ও গুড়ের পুর দিয়ে তৈরি হয়।
চাল গুঁড়োর পায়েস একটি অনন্য মিষ্টান্ন, যা দুধ ও গুড় দিয়ে রান্না করা হয় এবং এটি বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। গুড়ের চা হলো একটি স্বাস্থ্যে উপকারী পানীয়, যা চিনির পরিবর্তে গুড় ব্যবহার করে তৈরি করা হয়।
আর তিলের লাড্ডু হলো তিল ও গুড় মিশিয়ে তৈরি একটি শক্তিদায়ক স্ন্যাক্স, যা বিশেষ করে শীতে খাওয়া হয়।
টিপস:
# সকালে খালি পেটে এক গ্লাস গরম পানিতে সামান্য গুড় ও লেবুর রস মিশিয়ে খেলে ডিটক্স হয় শরীর।
# ব্যায়ামের পর এক টুকরো গুড় খেলে তা শরীরের গ্লুকোজ লেভেল ব্যালান্সে সাহায্য করে।
আখের গুড় আমাদের ঐতিহ্য, স্বাস্থ্য ও স্বাদের মিলনস্থল। আধুনিক প্রক্রিয়াজাত চিনি থেকে অনেক বেশি উপকারী এই প্রাকৃতিক বিকল্পটি শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং পুষ্টিগুণের কারণেও আপনার খাদ্যতালিকায় স্থান করে নিতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে- সব ভালো জিনিসও পরিমিত পরিমাণেই ভালো!
আপনার মতামত লিখুন :