পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি টেকসই ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। সরকারের মূল লক্ষ্য—এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো গঠন করা, যেখানে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা আর ফিরে আসতে না পারে।
তুরস্কে চলমান আন্তালিয়া কূটনৈতিক ফোরামে অংশগ্রহণের ফাঁকে তুর্কি টেলিভিশন টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা কখনোই বলিনি যে অবশ্যই একটি নতুন সংবিধান আসছে। বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়। জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান চায়, তাহলেই সেই সিদ্ধান্ত হবে। আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—যেসব আইনি ফাঁকফোকরে বিগত সরকার ধীরে ধীরে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে।
তিনি আরও বলেন, এই সরকার গঠিত হয়েছে জনগণের দাবির ভিত্তিতে। যারা জীবন দিয়েছে, আন্দোলন করেছে—তারা চায়, এমন একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে উঠুক যেখানে কেউ আর ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে।
উপদেষ্টা জানান, ইতোমধ্যে বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে এবং তারা সুপারিশ জমা দিয়েছে। এখন সেই সুপারিশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবায়নের প্রস্তুতি চলছে।
সরকারের অগ্রাধিকার নিয়ে প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতি। বিগত ১৫ বছরে দেশে একপ্রকার লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২০ বিলিয়নে নেমে আসে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ব্যাংকিং খাত পুনরুদ্ধারে। তারা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, কয়েক মাসের মধ্যেই এর ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাবে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ফেরত আনার অনুরোধ জানিয়েছি। এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অংশ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মান। আগের সরকারের সঙ্গে ভারতের যেভাবে সম্পর্ক ছিল, আমাদের সঙ্গে তা হবে না—তবে সম্পর্ক ভালোভাবে গড়ে উঠবে বলেই আমি আশা করি।
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ দুই দেশের সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে—এমন প্রশ্নে তৌহিদ বলেন, এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে সম্পর্কের সবকিছু এটিতে নির্ভর করে না। অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাজনৈতিক সহযোগিতা—এসব ক্ষেত্রেও আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে।
তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, তুরস্কের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বতন্ত্র ও হৃদয় থেকে উৎসারিত। বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে তুরস্কের জন্য গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে। আমরা চাই একটি দীর্ঘস্থায়ী, শক্তিশালী ও কার্যকর সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠুক। বাণিজ্যিক দিক থেকেও তুরস্ক সহযোগিতা করতে আগ্রহী।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বৈশ্বিক উষ্ণতায় অবদান খুব সামান্য, অথচ আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দেশের ১১ শতাংশ ভূমি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ।
তিনি অভিযোগ করেন, বিশ্বের অনেক দেশের কাছে এটি এখনও অগ্রাধিকার নয়। অথচ আমাদের জন্য এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমি আশাবাদী, একসময় বিশ্ব এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ) নিয়ে হতাশার কথা জানিয়ে তৌহিদ বলেন, সমস্যা সবাই চেনে, আলোচনাও হয়, কিন্তু কার্যকর প্রতিশ্রুতি আসে না। এটাই হতাশার মূল কারণ—যেটা করা দরকার, সেটা আমরা করছি না।