ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলি কিংবা নির্যাতন করে গত ১৬ বছরে প্রায় ৬০০ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও অন্য প্রতিবেশী চীন কিংবা নেপাল সীমান্তে তা অসম্ভব। দাদাগিরি ফলাতে বাংলাদেশ অংশে সীমান্ত হত্যায় আন্তর্জাতিক আইন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির তোয়াক্কা করছে না ভারত।
আবার বিজিবি-বিএসএফ প্রধানদের বৈঠকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বারবার সে কথার বরখেলাপ করেছে ভারত।
এদিকে, দেশি-বিদেশি চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের ভেতরে এ ইস্যুতে জনমত গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে একজন বাংলাদেশিকে আটকের পর উলঙ্গ করে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। ১২ বছর আগে এমন ভিডিও নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে দেশের মানুষ। বন্ধু রাষ্ট্রের বিএসএফ সদস্যের এমন নিষ্ঠুর নির্যাতন দেশবাসীকে হতবিহ্বল করেছে। ভাবিয়েছে ভারতের বিবেকবানদেরও।
এরপর সীমান্তে ১৩ বছরের কিশোরী ফেলানিকে হত্যার পর কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখার দৃশ্যও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’র তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৯ জন বাংলাদশিকে সীমান্তে বিএসএফ গুলি কিংবা নির্যাতন করে হত্যা করেছে। একইভাবে ২০২৩ সালে ২৮ জন, ২০২২ সালে ১৮ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন হত্যা কার হয়। এছাড়া ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫০৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সংখ্যায় কমলেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা।
এতো হত্যার পরও বিবেক নাড়া দেয়নি বিএসএফ সদস্যদের। ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ প্রধানদের বৈঠকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও বারবার সে কথার বরখেলাপ করেছে ভারত। বরং চোরাচালান ও আত্মরক্ষার অজুহাতে একের পর এক হত্যায় ব্যস্ত দেশটি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বাস্তবতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে মেলালে চলবে না। এ ইস্যুটি দেখতে হবে ভিন্ন দৃষ্টিতে। সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের এক একটি ঘটনার পর সরকার নড়েচড়ে বসে বা তীব্র সমালোচনা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না বলে আক্ষেপ তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে সেই বার্তা আমলে নিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী যথাযথ আচরণ করছে না। তাদের বুঝতে হবে সীমান্তে কোনো যুদ্ধাবস্থা নেই। এমন অবস্থায় গুলি করা কোনো সমাধান হতে পারে না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটি খুবই উদ্বেগের ও দুশ্চিন্তার। হত্যাকাণ্ডের স্থানটি নির্ধারণ হলেই বেশ কিছু বিষয় সামনে চলে আসবে। নো ম্যানস ল্যান্ড অতিক্রম করার আগেই অপর পাশ থেকে গুলি আসে কি না এটা চিহ্নিত করা জরুরি। সীমান্তে প্রবেশ করলেও সরাসরি নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করার বিধান নেই।
এই অধ্যাপকের মতে, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ভারতকে লিখিতভাবে অভিযোগ করে অফিশিয়ালি জবাব চাইতে পারে বাংলাদেশ। যদি এতে সমাধান না হয়, তাহলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনের মাধ্যমে সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, সীমান্তে হত্যার পরিসংখ্যান মূলত গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা। প্রকৃতপক্ষে হত্যার সংখ্যা বেশি, যা পরিসংখ্যানে আসে না। আন্তর্জাতিকভাবে সীমান্ত হত্যার যে আইন আছে, বাংলাদেশ সরকার ন্যূনতমভাবে তা প্রয়োগ করেনি। তাই আজও এর সমাধান হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সীমান্ত এলাকা খুবই অস্থিতিশীল এবং অরক্ষিত। সেখানে ভারত একটা প্রভাব বিস্তার করতে হিরোইজম প্রকাশ করে থাকে, যা সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। দুই দেশের বৈঠকে হোক বা আন্তর্জাতিক বিচারের মাধ্যমে হোক, এর সুরাহা না হলে দিন দিন হত্যাকাণ্ড আরও বাড়বে।
৫ আগস্ট পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় সীমান্ত রক্ষায় অন্তবর্তী সরকারের কঠোর অবস্থান বিজিবির মনোবল বাড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সীমান্ত হত্যা বন্ধে আলাদা কমিশন গঠনের পরামর্শ বিশ্লেষকদের। সীমান্ত হত্যা বন্ধে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে আসারও তাগিদ তাদের।
আপনার মতামত লিখুন :