ঢাকা শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

বকেয়ার চক্রে পেট্রোবাংলা-এনবিআর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৫, ০১:২৬ এএম

বকেয়ার চক্রে পেট্রোবাংলা-এনবিআর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পেট্রোবাংলার কাছে ভ্যাট বাবদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পাওনা ২২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা হলেও তা পরিশোধের কোনো উদ্যোগ নেই সংস্থাটির। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও সমাধান পাচ্ছে না এনবিআর। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সভায় উপস্থাপন করা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ-সংক্রান্ত চিঠির অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।


এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ভ্যাটেই বকেয়া ২২ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত বকেয়ার পরিমাণ ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। ভ্যাটের বাইরে আয়কর ও আমদানি শুল্ক বাবদ পাওনা রয়েছে আরও ১৪ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। আর এলএনজি আমদানির শুল্ক হিসেবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস পেট্রোবাংলার কাছে পাবে ১৪ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। অর্থসংকটে শুধু এনবিআরের বকেয়া নয়, আমদানি করা জ্বালানি, বিশেষ করে এলএনজি আমদানির দায়ও মেটাতে পারছে না পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধের জন্য পেট্রোবাংলাকে বিনা সুধে ঋণ দিচ্ছে অর্থ বিভাগ। এই ঋণ ১৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩৫ বছরে পরিশোধের সুযোগ পাবে সংস্থাটি। 


এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পেট্রোবাংলা বকেয়া বিল আদায় করতে না পারা এবং পর্যাপ্ত আয় না হওয়ায় এনবিআরের দায় পরিশোধ করতে পারছে না। এসব দায় জমে বিশাল অঙ্ক হয়ে গেছে। তাই অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে সহযোগিতা না করলে তাদের পক্ষ্যে তা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে। তবে অর্থ বিভাগ এর মধ্যে ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বিনা সুদে ঋণ দিয়েছে। একইভাবে বাকি দায় পরিশোধের জন্যও অর্থ বিভাগকে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করে সরকারের রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে সচেষ্ট রয়েছে এনবিআর।


এদিকে বদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বিল বকেয়া পড়ে আছে। এই টাকা আদায় করতে না পেরে বিপাকে আছে বাংলাদেশ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।


জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন কোম্পানিগুলোতে ১৩ হাজার ১১৮ দশমিক শূন্য ৯ কোটি টাকা এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২ হাজার ১৯৩ দশমিক ১৭ কোটি টাকা বকেয়া জমা পড়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এত টাকা গ্যাস বিল বকেয়া পড়ে থাকায় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো আর্থিক ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, বিতরণ কোম্পানিগুলোকে বিদেশ থেকে গ্যাস কেনার বিল পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া আমদানি করা এলএনজির বিল পরিশোধ করতে হয়। নিয়মিত বিল আদায় করতে না পারায় সংকটে থাকা পেট্রোবাংলা এ থেকে উত্তরণে জ্বালানি বিভাগের সহায়তা চেয়েছে।


বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) আওতাধীন বিভিন্ন শিল্পে গ্যাস সরবরাহ করে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। সরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প কারখানায় নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ করা হলেও ঠিকমতো গ্যাস বিল আদায় করা যাচ্ছে না। 


এনবিআর সূত্রে জানা যায়, পেট্রোবাংলার কাছে পাওনা টাকা আদায়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে এনবিআর। এনবিআরের বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ করতে পেট্রোবাংলাকে ঋণ দিতে অর্থসচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।  এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ভ্যাটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা।  এছাড়া বকেয়া পরিশোধে এনবিআর ও পেট্রোবাংলার মধ্যে বেশ কয়েকবার সভা হয়েছে। 


২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন করের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেশের ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রমে এবং জনসেবার মাত্রা ও পরিমাণ বৃদ্ধিকল্পে অধিক রাজস্ব জোগান দেওয়ার অন্যতম কৌশল হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বকেয়া রাজস্ব আদায়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছে। তাছাড়া আইএমএফের চাপ রয়েছে, যাতে এনবিআর তার রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে।


কাস্টমস আইন অনুযায়ী, কমিশনার বরাবর বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে আমদানি করা পণ্যের শুল্কায়ন সম্পন্ন করতে হয়। আইন অনুযায়ী, পণ্যের ওপর শুল্ক-কর পরিশোধেরও বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানির পর তাৎক্ষণিকভাবে বিল অব এন্ট্রি দাখিল এবং শুল্কায়ন না করেই তা নিয়ে গেছে। 


জানা গেছে, পেট্রোবাংলার কাছে উত্তোলিত গ্যাস বিতরণের বিপরীতে এনবিআর বকেয়া ভ্যাট বাবদ ১৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। দীর্ঘদিনেও পরিশোধ না হওয়ায় জটিলতা নিরসনে বকেয়া পরিশোধে এনবিআর ও পেট্রোবাংলার মধ্যে বেশ কয়েকবার সভা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তোলিত গ্যাস বিতরণের বিপরীতে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বকেয়া রাজস্বের ওই টাকা সুদ ছাড়া তিন অর্থবছরে পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগকে বিনা সুদে পেট্রোবাংলাকে ঋণ প্রদান করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে অর্থ বিভাগ পেট্রোবাংলাকে দেবে। 


এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে বরাদ্দ না পেলে এই বকেয়া পরিশোধ করা কঠিন ছিল। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া এই মুহূর্তে পেট্রোবাংলার পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও পেট্রোবাংলাও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা পায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, পদ্মা অয়েল কোম্পানি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড এবং মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে এনবিআরেরও বকেয়া রয়েছে।


এদিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এলএনজির ইনভয়েসের মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলে লাইবর প্লাস ৪ শতাংশ থেকে লাইবর ৫ শতাংশ পর্যন্ত হারে সুদ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যার ত্রৈমাসিক চক্রবৃদ্ধি সুদ রয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার থেকে অতিরিক্ত মূল্যে মার্কিন ডলার কিনে আইওসি ও এলএনজির মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে, যার ফলে পেট্রোবাংলা বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে পেট্রোবাংলার তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। 


বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আর্থিক সংকট রয়েছে। ডলারের সংকটে স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর কাছে এত টাকা বকেয়া পড়ে থাকা যথার্থ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 


এছাড়া জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন আইপিপির কাছেও অনেক টাকা বকেয়া জমা পড়ে আছে পেট্রোবাংলার।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!