বিটকয়েন যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৫, ০৮:২৯ এএম

বিটকয়েন যুবরাজ ইন্দ্রজিৎ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সাত বছর আগেও ছিলেন দিনমজুর, কিন্তু বর্তমানে আলাদিনের চেরাগ পেয়ে শতকোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। মূলত নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়া, অবৈধ বিটকয়েন ব্যবসা ও স্বর্ণ চোরাচালান করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। ঘনঘন বিদেশযাত্রা এবং দেশে-বিদেশে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার চরশ্রীপুর গ্রামের সুকুমার বিশ্বাসের ছেলে ইন্দ্রজিৎ। 

জানা গেছে, ইন্দ্রজিৎ ৪৫টি বিটকয়েনের মালিক, যার বাজারমূল্য ৫৫ কোটি টাকা। অনলাইন জুয়ার ব্যবসা করে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনলাইন জুয়ার মাফিয়াদের সঙ্গে যোগসাজশে দেশে একটি সিন্ডিকেট গড়ে নিষিদ্ধ ব্যবসা করে গেলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির বাইরে রয়েছেন। শ্রীপুর থানায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও এতদিন ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। ৫ আগস্টের পরও পুলিশকে টাকা দিয়ে অবাধে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুতুবুল্লাহ হোসেন মিয়া কুটি ও শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শরিয়তউল্লাহ হোসেন মিয়া রাজনের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস নানান অপরাধ ও অপকর্মে জড়িত। রাজনের সর্বশেষ নির্বাচনে ইন্দ্রজিৎ অর্ধকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন বলে জানা গেছে। রাজন ও কুটির অর্থদাতা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসন ও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পায়নি। ৫ আগস্টের পর রাজন ও কুটি আত্মগোপনে চলে গেলেও ইন্দ্রজিৎ ভোল পাল্টে বহাল তবিয়তে অপকর্ম করে যাচ্ছেন।

স্বর্ণ চোরাচালান, অনলাইন জুয়া, বিট কয়েন ব্যবসা, ভারতে অর্থ পাচার, জোরপূর্বক জমি দখল, জালজালিয়াতি, হত্যার হুমকি প্রদান, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। চরশ্রীপুর গ্রামের সাধারণ মানুষ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঢাকার সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। রহস্যজনক কারণে দুদদের অনুসন্ধান থমকে রয়েছে। ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, দুদক বা অন্য কোথাও অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই। টাকা দিলে সবার মুখ বন্ধ থাকে।

মাগুরার শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইদ্রিস আলী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস যদি অপরাধ করে থাকেন, তবে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুদকের তদন্তে থানার পুলিশ সহযোগিতা করবে। প্রাথমিকভাবে যতটুকু জেনেছি, ইন্দ্রজিৎ গ্রাম্য শত্রুতার শিকার। উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয় পেতেন কি না, জানতে চাইলে ওসি মন্তব্য করতে চাননি।

দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, কয়েক বছর আগেও দিনমজুর ছিলেন ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস। কোনো রকম বৈধ ও দৃশ্যমান আয়ের উৎস ছাড়াই হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। বর্তমানে তার আবাদি জমি, বিল্ডিং বাড়ি, দামি গাড়ি, বিমানে বিদেশভ্রমণসহ নানা অসংগতিপূর্ণ আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে দিলীপ বিশ্বাস নামে তার আলাদা নাগরিকত্ব রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার বেথুয়ার উত্তর বহিগাছিতে দুটি বাড়ি ও গাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে। গ্রামবাসী দিনমজুরের অঢেল সম্পত্তি, বিদেশি নাগরিকত্ব এবং ঘনঘন বিদেশ ভ্রমণ, নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়া ও অবৈধ বিটকয়েন ব্যবসার কারণ অনুসন্ধানে আবেদন করেন।

অভিযোগের বিষয়ে ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সব ভিত্তিহীন। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মহল আমার পেছনে লেগেছে। জমি দখল, হত্যার হুমকির অভিযোগে জিডি ও মাদক ব্যবসার বিষয়ে আমার শত্রুরা জড়িত। তারা আমাকে ফাঁসাতে চায়। আমার টাকা হয়েছে সেটা অনেকে মেনে নিতে পারছে না। বাবার জমিতে চাষাবাদ করেই সব টাকা রোজগার করেছি।’ ভারতীয় নাগরিকত্ব ও দ্বৈত পাসপোর্টের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। 

অনলাইন জুয়া ও বিটকয়েনের বিষয়ে তিনি প্রথমে অস্বীকার করেন, তবে প্রতিবেদকের কাছে থাকা ভিডিও ফুটেজে ‘নিজের মুখে তার কাছে ৪৫টি বিটকয়েন রয়েছে’ জানানো হলে তিনি বলেন, যে কারোর কাছেই বিটকয়েন থাকতে পারে। তাতে আপনার কী? আমি আপনাকে কৈফিয়ত দিব নাকি!’ বিটকয়েন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এমন প্রশ্নের উত্তরে ইন্দ্রজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘পারলে প্রমাণ করেন আমি অপরাধ করেছি।’

প্রাইমারির গণ্ডি পার হতে না হতেই ইন্দ্রজিৎ লেগে পড়েন কৃষিকাজে। এলাকাবাসী জানান, মাত্র তৃতীয় শ্রেণি থেকেই লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাবার সঙ্গে অন্যের জমিতে কাজ শুরু করেন। সাত বছর আগেও ইন্দ্রজিৎ অন্যের জমিতে কাজ করলেও বর্তমানে তিনি অঢেল সম্পদের মালিক। তিনি এখন অর্থের দাপট ও বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান এলাকায়।

ভুক্তভোগী একজন বলেন, ‘আমরা বায়না সূত্রে মনিকুমারের কাছ থেকে জমি কিনেছিলাম। সে টাকা নিয়ে ভারতে যায়। হঠাৎ ইন্দ্রজিৎ জমি দখল করতে আসে। আমি আদালতে মামলা করেছি। সে জোর করে জমি দখলের চেষ্টা করছে। এখন ওই জমিতে আমরা গেলেই সে হত্যার হুমকি দেয়।’

২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর শ্রীপুরে জমি দখলকে কেন্দ্র করে হত্যার হুমকির ঘটনায় নিরাপত্তা চেয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষে নিশিকান্ত মণ্ডল শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। দীর্ঘদিন দুই পরিবারের জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছিল। জমিতে ইন্দ্রজিত অবৈধভাবে জবরদখলের চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে গত ২৮ নভেম্বর ইন্দ্রজিৎ নিশিকান্ত মণ্ডলসহ তার পরিবারের সদস্যদের প্রকাশ্যে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন।

শ্রীপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শ্রীকান্ত মন্ডল বলেন, ‘ভারতনিবাসী মনিকুমার প্রথমে নিশিকান্তের কাছে জমি বন্ধক রাখে। তারপর বিক্রির কথাও বলে। কিন্তু সে ভারতে চলে যায়। এই জমি নিয়ে যেহেতু আদালতে মামলা চলমান, সেহেতু আদালতের নির্দেশনা ছাড়া কোনো পক্ষেরই নালিশি জমি জবরদখল করা ঠিক হবে না।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!