*দাপুটে কর্মকর্তাদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না। *ভোল পাল্টিয়ে আওয়ামীবিরোধী সাজার চেষ্টা।
রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর অপেশাদার, দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কড়া অ্যাকশন নিচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু পতিত শেখ হাসিনা সরকারের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে একইভাবে দলকানা ও অপেশাদার হয়ে উঠেছিলেন জনপ্রশাসনের একশ্রেণির অতি উৎসাহী কর্মকর্তা। বিগত সরকারের আমলাতন্ত্রের সেসব দাপুটে ও দলবাজ কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের অনেকে ইতোমধ্যে ভোল পাল্টে আওয়ামীবিরোধী সাজার অপচেষ্টা করছেন।
তবে সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী, অতি দলবাজ ও ক্ষমতাধর চিহ্নিত কর্মকর্তাদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না। অতীতের সার্বিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরে কালো তালিকাভুক্ত করার কাজ চলছে। তাদের নাম, ব্যাচ ও পরিচিতি নম্বরের পাশে ব্ল্যাকলিস্টেড মার্ক করে রাখা হচ্ছে। মাঠ প্রশাসনের সহকারী সচিব, উপসচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যায়ের এসব কর্মকর্তার কাউকে কাউকে দেওয়া হতে পারে বাধ্যতামূলক অবসর। তবে কোনো পেশাদার, নিরপেক্ষ, সৎ ও সজ্জন কর্মকর্তা যাতে অযথা হয়রানি না হন, সেটি বিশেষভাবে নজর রাখা হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ওইদিনই ভারতে পাড়ি জমান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু বিগত সরকারের নানা অনিয়ম সত্ত্বেও তাদের রেখে যাওয়া জনপ্রশাসন দিয়েই সরকার পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এই সরকারকে নানাভাবে বিতর্কিত ও কাজে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তুলে পেছন থেকে কলকাটি নাড়ছে একটি চক্র। ফলে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা থেকে কর্মচারী পর্যন্ত নানা দাবি নিয়ে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়কে অচল ও অবরুদ্ধ রাখার পাঁয়তারা চালিয়ে আসছে।
সর্বশেষ গেল সপ্তাহে আনসার সদস্যদের দাবি মেনে কমিটি গঠন করে দেওয়ার পরও তারা নানাভাবে সচিবালয় অবরুদ্ধ করে রাখে। এমনকি ছাত্র-জনতাকে পিটিয়ে আহত করে। এই অপ্রীতিকর ঘটনার পর বর্তমান খণ্ডকালীন সরকারের টনক নড়ে। জানা যায়, সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হওয়ায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মো. মাহবুব হোসেনকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব করেন। পরে নিয়মিত চাকরি থেকে অবসরে না পাঠিয়ে তাকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে থাকা কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হলেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
সূত্র মতে, তিনি টানা ১৫ বছর পদোন্নতি বঞ্চিতদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতিদানে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন বলেও গুরুতর অভিযোগ তোলা হয়েছে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এরপরও সরকার তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করেনি। এখন বঞ্চিত, যোগ্য ও ত্যাগী কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাজানো দলীয় প্রভাবমুক্ত করার সংগ্রাম চলছে; সেখানে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ভাই মইনুল ইসলামকে সচিব করার পাঁয়তারা করছে। মইনুল ইসলাম শুল্ক ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা। অথচ ওই ব্যাচের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে অনেককে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদের কয়েকজন এমনকি উপসচিবও হতে পারেননি। অন্যদিকে শেখ হাসিনার সাবেক মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর ভাগনে মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব। বিতর্কিত ও দলবাজ এই সচিবকে নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠার পর তিন দিন আগে ওএসডি করা হয়।
তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়র সচিব আওয়ামী ঘরানার সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকায় প্রশাসনকে দলীয়মুক্ত করার পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। তাদের বদৌলতে এখনো অনেক আওয়ামী সুবিধাভোগী সচিব থেকে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে মনে করছেন সচিবালয়ের দল নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা।
এসব দলবাজ কর্মকর্তার নেতৃত্বে জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পাশাপাশি রয়েছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম। সম্প্রতি বসুন্ধরায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সভা করেছেন। সেখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন সব কর্মকর্তা উপস্থিত হয়ে নানামুখী নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে দলবাজ এসব কর্মকর্তার অপসারণের ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম।
এদিকে, এখন পর্যন্ত প্রশাসন সার্ভিসে যত ব্যাচ রয়েছে, প্রত্যেকটি ব্যাচের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দলবাজ ও ছাত্রজীবনে পদধারীদের কালো তালিকায় নাম লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। বিসিএস ৯ম থেকে তৎকালীন সরকারে টানা ১৫ বছরে যত নিয়োগ হয়েছে পর্যায়ক্রমে সবার তালিকা হবে। দলনিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ায় এর বিকল্প নেই বলে জানান ভুক্তভোগীরা। বিশেষ এই তালিকায় ১৩ ব্যাচ, ১৫ ব্যাচ, ১৭ ব্যাচ, ১৮ ব্যাচ, ২০ ব্যাচ, ২২ ব্যাচ ও ২৭ ব্যাচকে প্রাথমিকভাবে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলেও সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে বদলি করে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করা হয়েছে জাহাঙ্গীর আলমকে। তিনি বিসিএস ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস ছিলেন এই দলবাজ কর্মকর্তা। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও তার প্রভাব কমেনি। বরং প্রশাসনে দাপট দেখিয়ে চাকরিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি। একইভাবে বিসিএস ১৩ ব্যাচের কর্মকর্তা ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. খলিলুর রহমান। ময়মনসিংহের সাবেক ডিসি ও স্থানীয় সরকারের পৌর-১ শাখার দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিটি মেয়রের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এদিকে সাতক্ষীরার সাবেক ডিসি ও বর্তমান পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসানের বিরুদ্ধেও দলবাজ কর্মকর্তা হিসেবে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তিনিই নন, বিসিএস ১৩ ব্যাচের আরও অন্তত এক ডজন দলবাজ কর্মকর্তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রশাসনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। টানা ১৫ বছর যারা পদোন্নতিসহ সরকারি সব ধরনের সুবিধাবঞ্চিত ছিলেন, তারাও তাদের দাপটের কাছে অনেকটা অসহায় বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে খুলনা ও লক্ষ্মীপুর জেলার সাবেক ডিসি, বরিশাল ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব ও বর্তমান বিপিসির সচিব আমিনুল আহসান, মো. শহীদুল্লাহ ও নুরুল আলম এবং রয়েছেন প্রাইমারির ডিজি আবদুস সামাদ। ১৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা স্পারসের দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির চরম অভিযোগ উঠেছিল।
এ ছাড়া ১৫ ব্যাচের আরেক আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদী কর্মকর্তা আবুল হাসনাত হুমায়ুন কবির। বর্তমানে ভোল পাল্টে বিএনপির সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। এ ছাড়া সৈয়দ সালমা নাসরীন জালিয়াতির মাধ্যমে ঝিনাইদহ জেলা কোটায় চাকরি নেন। তার স্থায়ী বাড়ি চাঁদপুর। তিনি জাবির ভিসি আলাউদ্দিনের অনুসারী বলেও গুজব রয়েছে। সুবিধাবাদীর তালিকায় কেরামত আলী ও বাকশালের অনুসারী মো. আখতারুজ্জামান রয়েছেন।
আরও ভোল পাল্টানোর তৎপরতায় ব্যস্ত নাজমূস সাদাত সেলিম, হেলাল মাহমুদ শরীফ, সিরাজুন নূর চৌধুরী, সাবিরুল ইসলাম, মাহমুদুর হাসান, সায়মা ইউনূস, মানজারুল মাখন, মোস্তফা কামাল, জাহেদা পারভীন, মো. তোফাজ্জল হোসেন, ড. আমিনুর রহমান, মো. সারোয়ার আলম, নাভিদ শফিউল্লাহ (সাবেক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান ফকিরের জামাতা), মো. জাহিদ হোসেন (সাবেক বিমানের এমডি), জহির রায়হান, মাহবুব আলম তালুকদার, খালিদ আহমেদ (বাংলাদেশ-ভারত গ্যাস পাইপলাইনের পরিচালক), মো এনামূল হক (আওয়ামী সুবিধাবাদী-রং বদলাতে পটু), মো হাবিবুর রহমান (প্রয়াত সাবেক জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ক্যাশিয়ার)।
এ ছাড়া সাবেক ডিসি ও আমেরিকায় দূতাবাসের ইকোনমিক মিনিস্টার মাহমুদুল হাসান, বিমানের সাবেক এমডি ও অতিরিক্ত সচিব সফিউল আজিম, অর্থ মন্ত্রণালয়ের মফিদুল ইসলাম, সাবেক আরেক মন্ত্রীর পিএস হুমায়ুন, জনপ্রশাসন মন্ত্রীর এলাকার সাবেক ডিসি ও পরবর্তী ডিজি হওয়া সফিকুল ইসলামও সুবিধাবাদী আওয়ামী দোসর হিসেবে পরিচিত। এরা কালো তালিকাভুক্ত হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
আপনার মতামত লিখুন :