ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
তিন পিআরও’র হাতে আলাদীনের চেরাগ

গড়েছেন শতকোটি টাকার সম্পদ

মেহ্দী আজাদ মাসুম

প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০২৪, ১১:৩১ পিএম

গড়েছেন শতকোটি টাকার সম্পদ

মীর মোহাম্মাদ আসলাম, শরীফ মাহমুদ অপু ও শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মীর মোহাম্মাদ আসলাম, শরীফ মাহমুদ অপু ও শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ। তিনজনের দুজন তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা, আর একজন বেতারের।

চাকরিতে যোগ দিয়ে টানাটানির মধ্য দিয়েই জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। তবে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে যোগ দিয়ে পুরোপুরি বদলে ফেলেন নিজেদের। সান্নিধ্য-সানুগ্রহ পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধর সাবেক তিন মন্ত্রীর। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও নসরুল হামিদ বিপুর তথ্য কর্মকর্তা (পিআরও) হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় এক দশক আগে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জ্বালানি, খনিজ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর আর তাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আলাদীনের চেরাগ হাতে না পেলেও মাত্র ১০ বছরে জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। ব্যাংকে নামে-বেনামে, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনদের নামে এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ-সম্পদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই তিন সরকারি কর্মকর্তা অন্তত তিনশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মীর মোহাম্মাদ আসলাম ঢাকা-৩ আসন থেকে চারবার নির্বাচিত সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ খান বিপুর প্রায় ১০ বছরের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০ ব্যাচের তথ্য কর্মকর্তা।

শরীফ মাহমুদ অপু তেজগাঁও-হাতিরঝিল থেকে নির্বাচিত সাবেক স্বরাষ্ট্র আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রায় দশ বছরের তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ নোয়াখালী থেকে নির্বাচিত ক্ষমতাধর সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের প্রায় ৮ বছরের তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বেতারের অনুষ্ঠান ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। 

গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এর পর থেকেই সচিবালয়ে পরিবর্তন শুরু হয়। এই পরিবর্তন হওয়ায় দায়িত্ব থেকে ছিটকে পড়েন সচিবালয়ে পিআরও হিসেবে কর্মরত দাপুটে আসলাম, অপু ও ওয়ালিদ। তাদের চলনে-বলনে কারোরই মনে হতো না এরা তিনজন তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা। মনে হতো আজীবনের জন্য বরাদ্দ নিয়েছেন জ্বালানি, স্বরাষ্ট্র ও সেতু মন্ত্রণালয়ের। দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের একটি সূত্র জানায়, সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয়ের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস), তথ্য কর্মকর্তা (পিআরও) এবং ব্যক্তিগত সহকারীর (পিও) বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। এদের মধ্যে আলোচিত আসলাম, অপু ও ওয়ালিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে জোরেশোরে। সূত্র আরও জানায়, এদের প্রত্যেকেরই নামে-বেনামে অন্তত শতকোটি টাকার অর্থ-সম্পদের তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। দেশের সীমানা পেরিয়ে মালয়েশিয়া, দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন অর্থ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও খুলেছেন বিদেশে।

সাবেক জ্বালানির পিআরও আসলাম : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন। ২০ বিসিএস তথ্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তা গত ১১ বছর ধরে এই মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। গত সপ্তাহে তাকে এ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তথ্য কর্মকর্তা হয়েও সিন্ডিকেট করে তদবির ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ রয়েছে। তথ্য কর্মকর্তা হয়েও তিনি রূপান্তরিত গ্যাস কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক ছিলেন। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের নাম ভাঙিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিভিন্ন কোম্পানিতে তদবির বাণিজ্য আসলামের নিত্যদিনের কাজ। এ জন্য সে তার বিশ্ববিদ্যালয় ও ২০তম বিবিএস  সহপাঠীদের মিলে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। তার ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের যেসব কর্মকর্তা বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে যোগদান করতে কিছুদিনের মধ্যে তাদের নিজের সিন্ডিকেটের সদস্য বানিয়ে নিত। তার সিন্ডিকেটে তিন-চারজন গণমাধ্যমকর্মীও ছিল।

এছাড়া আওয়ামী লীগ ও সাবেক ছাত্রলীগের যেসব নেতা তার সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তাদের নিয়েও তার সিন্ডিকেট ছিল। বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে এসব ব্যক্তিকে নিয়োগ দিত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। যেসব কোম্পানিতে আসলামের বন্ধু বেশি পরিচালক থাকত ওই কোম্পানির বিভিন্ন কাজের এক বড় অংশ নিজেরা বাগিয়ে নিত। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে নামে-বেনামে একাধিক কোম্পানি রয়েছে আসলামের। 

সূত্র জানিয়েছে, কোনো কোম্পানির এমডি বা অন্য কোনো কর্মকর্তা যদি এই সিন্ডিকেটের কথা না শুনত তাহলে সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নামসর্বস্ব অনলাইন বা পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করাত আসলাম। পরে আবার আসলামই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে সেই প্রতিবেদককে নিয়ে সমঝোতার নামে কাজ বাগাত।  

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক পিআরও অপু : সিন্ডিকেট করে ঘুষ ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে বেড়িয়ে আসা অন্যরা হলেন তার সাবেক পিএস অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু। জনসংযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ আগস্ট দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিম ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে।

সেতু মন্ত্রণালয়ের সাবেক পিআরও ওয়ালিদ: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাবেক পিআরও শেখ ওয়ালিদ ফয়েজের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। সংস্থাটির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তার তিনটি ফ্ল্যাট, দুটি প্লট এবং কয়েকটি ব্যাংকে অসংখ্য হিসাব পেয়েছে তারা। এসব ব্যাংক হিসাবে রয়েছে অনেক টাকা। বিদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও টাকা পাচারের অভিযোগেরও সত্যতা পেয়েছে দুদক।

আরবি/জেডআর

Link copied!