ময়মনসিংহের ভালুকায় সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যু ও চাঁদাবাজ চক্রের খপ্পরে পড়েছেন নাজমুল ইসলাম নামে এক প্রবাসী শিল্পপতি। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন তিনি।
অভিযোগে সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ২০ বছর আগে ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের আমতলী এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপনের উদ্দেশ্যে ৩৫ বিঘা নিষ্কন্টক ও দেয়াল দিয়ে ঘেরা জমি কেনেন তিনি। পরে নিয়মানুযায়ী নামজারী ও খাজনা পরিশোধ করার পাশাপাশি কেয়ারটেকার নিয়োগ দিয়ে জমি দেখাশোনা করে আসছিলেন তিনি।
স্থানীয় বনবিভাগ ওই জমির ১৫৪ নং দাগে তাদের দাবি রয়েছে বলে জানালে ২০০৬ সালে নাজমুল ইসলাম ভালুকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে এ বিষয়ে মামলা করেন। পরে এসিল্যান্ড নিজেদের সার্ভেয়ার দিয়ে জরিপ ও স্কেচম্যাপ তৈরি করে ওই জমি বনের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা বনবিজ্ঞপ্তিত ভূমি থেকে অবমুক্ত করতে সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রতিবেদন ময়মনসিংহ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ফরেস্ট সেটলমেন্ট অফিসার বরাবরে পাঠান। সেই প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ফরেস্ট সেটলমেন্ট অফিসার নিজে সরেজমিনে তদন্ত করে রায় দেন। রায়ে তারা জমিটি বনের দাবি থেকে অবমুক্তি করেন ও ২০ ধারায় চূড়ান্তভাবে সংরক্ষিত বন ঘোষণার বহির্ভূত রাখার জন্য আদেশ প্রদান করেন।
এরপর বনবিভাগ ২০০৭ সালে পুনরায় ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার আদালতে আপিল করে। ভুক্তভোগী শিল্পপতির জমির সকল কাগজ পর্যালোচনা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও ফরেস্ট সেটলমেন্ট অফিসারের রায়ের কপি ও এসিল্যান্ড কার্যালয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার আদালত ওই জমি বনের বিজ্ঞপ্তি বহির্ভূত রাখার আদেশ বহাল রাখেন এবং বনের পক্ষ থেকে করা আপিল আবেদন খারিজ করে দেন।
এরপর ২০১৭ সালে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করে না পেয়ে আদালতের সকল রায় ও আদেশ অগ্রাহ্য করে জমির প্রকৃত মালিককে নানাভাবে হয়রানি শুরু করে স্থানীয় বন বিট কর্মকর্তা। পরে বাধ্য হয়ে তিনি ২০১৮ সালে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। শুনানীর পর হাইকোর্ট ‘যতদিন পর্যন্ত এই জমি সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তি না হবে ততদিন পর্যন্ত’ নাজমুল ইসলামের পক্ষে স্ট্যাটাস কো ও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
পরবর্তীতে দীর্ঘদিন কোন ঝামেলা ছাড়াই নিজ জমি কেয়ারটেকার দিয়ে দেখভাল এবং ভোগদখল করে আসছিলেন তিনি। তবে নাজমুল ইসলাম স্বপরিবারে বিদেশ চলে গেছেন বলে ২০২২ সালে জানাজানি হবার পর স্থানীয় ভুমিদস্যু ও চাঁদাবাজ চক্রের হোতা আবু জাফর সরকার ও আওয়ামী সন্ত্রাসী গ্যাংদের সাথে নিয়ে জবরদখলের উদ্দেশ্যে আবিরর্ভূত হয় বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম। ২০২৩ সালে সাজানো হয় বনের জমি উদ্ধারের নাটক। ওই শিল্পপতি দেশের বাইরে থাকার সুযোগে হাইকোর্টের ২০১৮ সালের নির্দেশ অবমাননা করে ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট হবিরবাড়ি বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম খানের নেতৃত্বে ওই জমি উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে সেখানে অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রজাতির চারা রোপণ করা হয়।
অনুসন্ধান ও অভিযোগে জানা গেছে, অন্তত ছয় বার ওই জমির কেয়ারটেকারদের মারধোর করে রক্তাক্ত করে অভিযুক্তরা। এমনকি গভীররাতে অস্ত্রের মুখে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করে চক্রটি।
অনুসন্ধান বলছে, বনের কাঁধে ভর করে ওই জমি জবরদখলের জন্য বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ও ভুমিদস্যুদের মাঝে অন্তত ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়। তার পর থেকেই আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে ওই জমি দখল করতে বেপরোয়া হয়ে উঠে সম্মিলিত দস্যুচক্রটি। এ বিষয়ে বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে ভালুকা মডেল থানায় অন্তত ছয় বার অভিযোগ করলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব ও চক্রের বাঁধায় আইনগত কোন সহযোগিতা পাননি ভুক্তভোগী শিল্পপতি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনের পতনের পর নতুন করে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশের কাঁধে ভর করে ওই জমি জবরদখলের জন্য বন বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলম ও স্থানীয় ভূমিদস্যু চক্র নতুন করে নাটক শুরু করেন। কোন কারন ছাড়াই ওই জমির ময়লা সরানোর কাজ তদারকীর জন্য শিল্পপতির নিয়োগ করা কেয়ারটেকারসহ তিন জনকে গত ১৮ নভেম্বর অপহরণ করে আশরাফুল গ্যাং। তিন ঘণ্টা পর সেনাবাহিনীর কমান্ডার কর্নেল মাহমুদ ও সিও মেজর নোমানের হস্তক্ষেপ ও প্রশাসনের চাপের মুখে ভুক্তভোগীকে ফেরৎ দিতে বাধ্য হয়। পরে ওই শিল্পপতি সেনাবাহিনীর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার কাছে বিট কর্মকর্তা আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে অপহরণ ও চাঁদাবাজির লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে হবিরবাড়ি বিট অফিসার আশরাফুল আলম খানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেনি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া, অন্যান্য অভিযুক্তরাও এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
আপনার মতামত লিখুন :