ঢাকা রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

জাদুর কাঠির স্পর্শে গাজী লিকুর অঢেল সম্পদ!

মাইনুল হক ভূঁঁইয়া

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪, ১১:০৭ এএম

জাদুর কাঠির স্পর্শে গাজী লিকুর অঢেল সম্পদ!

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গাজী হাফিজুর রহমান লিকু। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব-২ ছিলেন। একদিকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকা, আরেক দিকে গোপালগঞ্জের অধিবাসী হওয়ার গরম দুই গরম তাকে সীমাহীন বেপরোয়া করে তোলে। চলনে-বলনে ছিল না কোনো মাধুর্য। বিনয় কী তিনি বুঝতেন না। চেয়ারেরও যে একটি ন্যূনতম শুদ্ধতা আছে, সে কথাও তিনি বরাবর ভুলে থেকেছেন।

সরকার পতনের আগপর্যন্ত তিনি কদাচিৎ অফিসে সময় দিয়েছেন। চাউর আছে, একাধিক উপ-অফিস ছিল তার। সেসব অফিসে ‘ব্রিফকেস পার্টি’র ভিড় লেগেই থাকত। অনেক রাত পর্যন্ত সেগুলোতে চলত রমরমা তদ্বির বাণিজ্য। তখনই অনেকে বলে বেড়িয়েছেন, সেসব বাণিজ্যে লাখো-কোটি টাকার গন্ধ পাওয়া যেত বাতাসে। এমন করেই লিকু নামের এক অখ্যাত মানুষ রাতারাতি হয়ে ওঠেন হাজার কোটি টাকার সম্রাট।

১৫ বছরের পথচলায় ক্ষমতার জাদুর কাঠির স্পর্শে গড়ে ওঠে তার সম্পদের পাহাড়। স্ফীত হয়েছে ব্যাংক ব্যালান্স। জুলাই বিপ্লবে সরকারের পাশাপাশি তার মসনদ ধসে পড়লে তিনি হয়ে যান লাপাত্তা। গোপালগঞ্জের সব নেতা-কর্মীর মতো এখন তিনিও অধরা। স্বাভাবিকভাবেই লিকু ও তার বউ-বাচ্চাদের সম্পদের খোঁজে নেমে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চোখ কপালে ওঠে। খোঁজ মেলে স্ত্রী রহিমা আক্তার, শ্যালক শেখ মো. ইকরাম ওরফে হালিম মোল্লাসহ নিকটাত্মীয়দের নামে অঢেল সম্পদের। অথচ তারা কেউই সরকারি-বেসরকারি কোনো চাকরিতে তো ছিলেনই না, এমনকি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারে কাছেও থাকার কোনো প্রমাণ নেই।

জানা যায়, বেপরোয়া তদ্বির বাণিজ্য ও ঘুষ-দুর্নীতি থেকে নিজেকে আড়াল করতে তিনি প্রায় সব সহায়সম্পদই স্ত্রী-সন্তান, শ্যালক ও কাছের মানুষদের নামে গড়ে তুলেছেন। এটা তার একধরনের ধূর্ততা আরকি!

এবার কমিশন লিকুর ঘুষ, দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অর্থে গড়া সম্পদ ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান চালাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগে (বিএফআইইউ) ইতিমধ্যে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক।

এদিকে দুদক লিকুর ব্যবসা-বাণিজ্যের খোঁজও পেয়েছে। তার স্ত্রী রহিমা আক্তারের নামে মেসার্স রাফি এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ, মৎস্য খামার, পৈতৃক জমিতে পাঁচতলা ভবন, শ্যালক হালিম মোল্লার নামে ছয়তলা বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাট, কুয়াকাটার লাইট হাউজের পাশে ওশান ব্লু রিসোর্ট এবং পরিবহন খাতে বিনিয়োগের তথ্যও দুদকের হাতে পৌঁছেছে।

সম্পদের তথ্য স্ত্রী হালিমা আক্তারের নামে মেসার্স রাফি এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজের জন্য গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার রামদিয়ায় কেনা হয়েছে ৪৭০ একর জমি।

কোটালীপাড়ার কুশলী ইউনিয়নের গোড়াদা গ্রাম ও সদর থানার কাজুলিয়ায় রয়েছে ৪০০ বিঘা জমির ওপর মাছের ঘের। খুলনা-ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটে ৪২টি লাক্সারি বাসে বিনিয়োগ রয়েছে লিকুর। টুঙ্গিপাড়ার মো. কালুর সঙ্গে পার্টনারশিপে এই পরিবহন ব্যবসা। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতিটি বাসের বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। অংশীদারে ব্যবসা রয়েছে ঢাকা-সাভার রুটে চলাচলকারী ওয়েলকাম পরিবহনেও।

গোপালগঞ্জ সদরের থানাপাড়া সড়কে পৈতৃক ভিটায় তিনি প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ করে বানিয়েছেন আলিশান পাঁচতলা বাড়ি। রাজধানীর বছিলায় মধু সিটিতে প্রায় এক বিঘা জমিতে বানিয়েছেন ছয়তলা বাড়ি। আদাবরের ৬ নম্বর সড়কের ৫৮৩ নম্বর বাড়ির এ-৩ ফ্ল্যাটটি কিনেছেন স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া ধানমন্ডি থানার রায়েরবাজারের ২৫ মিতালী রোডেও রয়েছে বেনামী ফ্ল্যাট। কুয়াকাটায় লাইট হাউজের পাশে কোটি টাকা খরচ করে বানিয়েছেন ওশান ব্লু রিসোর্ট। এটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন তার সেজ ভাই গাজী মোস্তাফিজুর রহমান।

এদিকে দুদকের অনুসন্ধানে মিলেছে আরও কিছু বেনামী সম্পদের তথ্য। এর মধ্যে গোপালগঞ্জের গোবরায় ডুপ্লেক্স বাড়ি, একই জায়গায় একটি তিনতলা বাড়ি ও সোনাকুড়ে নীলের মাঠের পাশে ১০ শতাংশ জমিতে একটি একতলা বাড়ি। পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বকুলতলায় খ্রিষ্টান কবরস্থানের পাশে ছোট ভাই গাজী শফিকুর রহমানের নামে ৭ কাঠা জমি, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হুমায়ুনের কাছ থেকে শ্যালকের নামে কেনা ১৫ বিঘা জমির ওপর দিঘি এবং ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ভায়রা ওমর আলীর নামে পাঁচতলা বাড়ি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোপালগঞ্জের থানাপাড়া সড়কে নিজ বাড়ির পাশে ছয়তলা বাড়ি করেছেন লিকুর শ্যালক হালিম মোল্লা। ওই বাড়ির নির্মাণ খরচের পুরোটাই যোগান দিয়েছেন লিকু।

গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১৩ নম্বর সড়কের সোনাকুড়ে নীলের মাঠের পাশে ১৩ শতাংশ জমির ওপর হালিম মোল্লা তার স্ত্রী স্বর্ণা খানমের নামে ১০ তলা কমার্শিয়াল কাম আবাসিক কমপ্লেক্স ‘স্বর্ণা টাওয়ার’ বানিয়েছেন। ভবনটিতে রয়েছে সুইমিংপুলসহ ৪০টি ফ্ল্যাট। টাওয়ারের নির্মাণ খরচের পুরোটাই বহন করেছেন লিকু।

ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দাবি করেছে, সহায়-সম্পদের বাইরে রয়েছে লিকুর নগদ কয়েক হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পরিবর্তে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে এই অর্থ বহু আগেই বিদেশে পাচার হয়েছে।

সূত্রমতে, বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় তার রয়েছে একাধিক বাড়ি, রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য।

আরবি/জেডআর

Link copied!