ঢাকা শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

রাতের ভোটের অন্যতম দুই কারিগর হেলালুদ্দীন-মোস্তফা

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ০৪:৫০ পিএম

রাতের ভোটের অন্যতম দুই কারিগর হেলালুদ্দীন-মোস্তফা

ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন ছিল বিতর্কিত। এর মধ্যে দিনের ভোট রাতে অনুষ্ঠান নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। রাতের ভোটের অন্যতম দুই কারিগর ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহচর দুই প্রভাবশালী সচিব।

তারা হলেন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন। এ দুই সচিব সরকারের শীর্ষপর্যায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করেননি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আমলে যেসব সচিবের নাম বরাবরই বিতর্কে জড়িয়েছে, তাদের মধ্যে এই দুজনও ছিলেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গোপন বৈঠকের অভিযোগ ছিল বিতর্কিত ইসি সচিব হেলালুদ্দীনের বিরুদ্ধে। মোস্তফা কামাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালনের সময় পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন ও গুম-খুনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দুর্নীতির সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্যও ছিলেন মোস্তফা কামাল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ দুই সচিব দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদও অর্জন করেন। বিদেশে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে ইতিমধ্যে দুদক তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মধ্যে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আড়াই মাস পর সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত বুধবার সন্ধ্যায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের খুলশীর একটি বাসা থেকে কোতোয়ালি থানার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মোস্তাফা কামাল উদ্দীনকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সহায়তায় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। মোস্তাফা কামালের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকালই তাকে ঢাকায় আনা হয়েছে।

এদিকে হেলালুদ্দীন ও মোস্তফা কামালকে রিমান্ডের জন্য আদালতে তোলা হবে জানিয়েছেন ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাাখতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করাসহ বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ ছিল। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালনকালেও তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ছিল। আঠারোর নির্বাচনের সময় ইসি সচিব থাকায় নির্বাচন-সংক্রান্ত বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে নিয়মিত গণমাধ্যমের সামনে হাজির হতেন তিনি। সে সময় নির্বাচনের আগে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে অংশ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বিএনপি। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের চতুর্থ তলার পেছনের কনফারেন্স রুমে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর রাতে ওই গোপন বৈঠক হয় বলে গণমাধ্যমে খবর হয়েছিল।

সে সময় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী অভিযোগ করেছিলেন, হেলালুদ্দীনসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাজ্জাদুল হাসান, সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমদ, সাবেক পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন সচিব মহিবুল হক, সাবেক ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার আলী আজম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ কাজী নিশাত রসুল ওই বৈঠকে অংশ নেন।

পরে হেলালুদ্দীন আহমদ চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজেও একই ধরনের গোপন বৈঠক করেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই বৈঠকে ইসির জনসংযোগ শাখার তৎকালীন যুগ্ম সচিব আসাদুজ্জামানও ছিলেন। তবে ওই বছরের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় ইসিতে সংবাদ সম্মেলন করে হেলালুদ্দীন আহমদ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে গোপন বৈঠকের খবরকে প্রপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেন। তিনি দাবি করেছিলেন, তাকে বিতর্কিত ও হেয় করার জন্য এ ধরনের প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে।

স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘুষ, চাঁদাবাজি, নিয়োগ-টেন্ডার বাণিজ্য, দুর্নীতি, গুম-খুন, বিরোধী দল বা মতকে দমন-পীড়ন নির্যাতনের যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব মোস্তফা কামাল। আসাদুজ্জমানের প্রতক্ষ্য মদদে মোস্তফা হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছেন নিজের ইচ্ছেমতো। আওয়ামী লীগ ঘরানার মতাদর্শের হওয়ায় সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন সর্বোচ্চ। মন্ত্রী কামাল ও সচিব কামাল সিন্ডিকেট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারোরই ছিল না। নানান অপকর্ম মুখ বুজে হজম করতে হয়েছে সবাইকে।

১৯৮৪ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা মোস্তাফা কামাল উদ্দীন ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পান। ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তাকে পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র সচিব করা হয়। ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয় মোস্তফা কামালকে। ক্ষমতার পালাবদলের পর গত ১৯ অগাস্ট ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে।

অন্যদিকে, ১৯৮৮ সালে সপ্তম বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া হেলালুদ্দীন আহমদ ক্ষমতাচ্যুত ‘আওয়ামী লীগ সরকারের একান্ত অনুগত আমলা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হেলালুদ্দীন ২০২২ সালে অবসরে যাওয়ার আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি নির্বাচন কমিশন সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অবসরে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম আদালতে একরামুল করিম নামের এক মুক্তিযোদ্ধার করা মামলায় সাবেক ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কে এম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্যদের আসামি করে চট্টগ্রামে প্রতারণা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়েছে।

বাদীর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, মামলাটি আদালত পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলসহ অনেক জনপ্রিয় নেতার অংশগ্রহণ ছিল না। সাধারণ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। যাঁরা কমিশনে ছিলেন, তাঁদের ব্যর্থতার কারণে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নির্বাচনী মাঠে একপেশে আচরণ করেছেন। বিপুল টাকা ব্যয়ে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তাতে সংবিধানের খেলাপ করেছেন নির্বাচন কমিশনারসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাই রাষ্ট্রদ্রোহ ও প্রতারণার মামলা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব নির্বাচনে যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করায় তাঁদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীনের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা হিসাব বিবরণী তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কাউন্সিল (সিআইসি)। গত ৬ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে।

বুধবার (২৩ অক্টোবর) হেলালুদ্দীন আহমেদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটকের পর ব্যাংক হিসাব তলবের তথ্য জানাজানি হয়। চিঠিতে করদাতার (হেলালুদ্দীন) ও তার একক বা যৌথ নামে অথবা তার মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের (কোম্পানি ব্যতীত) নামে ব্যাংকে বা প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত বা রক্ষিত যেকোনো মেয়াদি আমানত হিসাব (এফডিআর ও এসটিডি হিসাবসহ যেকোনো ধরনের বা নামের মেয়াদি আমানত হিসাব), যেকোনো ধরনের বা মেয়াদের সঞ্চয়ী হিসাব, চলতি হিসাব, ঋণ হিসাব, ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট, লকার বা ভল্ট, সঞ্চয়পত্র বা অন্য যেকোনো ধরনের সেভিংস ইস্ট্রুমেন্ট, ইনভেস্টমেন্ট স্কিম বা ডিপোজিট স্কিম বা অন্য যেকোনো ধরনের বা নামের হিসাব পরিচালিত বা রক্ষিত হয়ে থাকলে ওই হিসাবের বা হিসাবগুলোর তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

চিঠি পাওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে এসব তথ্য ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে হালনাগাদ বিবরণী ও ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের বিবরণীসহ দিতে বলা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য আসা শুরু হয়েছে।

আরবি/ এইচএম

Link copied!