গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পতন হয় শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। আর এরপর থেকেই এক এক করে বেরিয়ে আসছে দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নানা অপকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
সেই ধারাবাহিকতায় এবার অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, বিভিন্ন প্রকল্প থেকে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। সেই সঙ্গে দেশের বড় বড় প্রকল্প থেকে করেছেন অর্থ আত্মসাৎ। বাদ যায়নি পদ্মা সেতু কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্র প্রকল্পও। গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামের একটি ওয়েবসাইটে গত ১৭ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে হাসিনা পরিবারের ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার আত্মসাতের কথা বলা হয়। সেখানেও উঠে আসে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম। ‘দ্য মিরর এশিয়া’র এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) শেখ হাসিনার ছেলে জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ- পদ্মাসেতু, স্যাটেলাইট ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে বাংলাদেশের টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছেন। জয়ের অর্থ পাচারের শুরুটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে থেকেই বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের ছেলে রিজভী আহাম্মেদ ওরফে সিজার। সম্প্রতি নিউইয়র্কের টাইম টেলিভিশনের সাথে আলাপচারিতায় এসব অভিযোগ করেছেন তিনি।
জয়কে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে সাজা খেটেছেন সিজার। একই মামলায় বাংলাদেশেও তাকেসহ পাঁচজনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৫ সালের মার্চে দেওয়া ওই রায়ে রিজভী আহাম্মেদ সিজারের ৪২ মাসের কারাদণ্ড হয়।
সিজারের মতে, জয়ের পাচার করা অর্থের সন্ধান পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (এফবিআই) ঘুষ দেয়ার কারণে তিনি জেল খেটেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাটের ফেয়ারফিল্ড কাউন্টির বাসিন্দা।
২০০৮ সালে দুর্নীতির জন্য বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু তহবিল দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করে। সিজার বলেন, এরপর এফবিআইয়ে কাজ করা এক বন্ধুর সাথে একটা সমঝোতা হয়। তাকে আমি এই ডলার দেব, সে আমাকে জয় ও তার পরিবারের দুর্নীতির তথ্য দেবে। তিনি একদিন ব্যাংক হিসাব দিয়েছিলেন। একদিন এফবিআই জয়ের দুর্নীতির যে অনুসন্ধান করছিল সেগুলোর রিপোর্ট দিয়েছিল।
সিজার জানান, আমার ওই বন্ধুর এক বন্ধু ছিল যে ২০১৩ সালের দিকে ইরানি প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা করতো। ইরান তখন আমেরিকার অথনৈতিক স্যাংশনে ছিল। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার বন্ধুটা ধরা পড়ে। আমিও সেই মামলায় জড়িয়ে পড়ি। এই সূত্রে মোবাইলে আমাদের টেক্সট পেয়েছিল এফবিআই কমকর্তারা। এটা দেখেই তারা আমাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসে। তবে আমাদের লক্ষ্য ছিল জয়ের দুর্নীতি, তার পরিবারের দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিংয়ের তথ্যসহ ব্যাংক হিসাব বের করে জনসম্মুখে উন্মুক্ত করে দেয়া।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এইচএসবিসি হংকং ব্যাংকের শাখায় জয়ের ৮৫ বিলিয়ন ডলার ছিল। অ্যাকাউন্টের নাম ছিল ওয়াজেদ কনসালট্যান্ট। সিমোন্ট এবং জয় কনসালট্যান্ট নামে দুইটি শেল কোম্পানি করেছিল ক্লেনেন আইল্যান্ডে। জয় এবং হাসিনার নামে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মানি লন্ডারিং মামলা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। ২০০৯ সালে এফবিআই ইভেস্টিগেশন টিমের প্রধান এই মানি লন্ডারিং মামলার জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাকে কোন ধরনের সহায়তা করেনি।
অভিযোগ আছে, যুক্তরাষ্ট্রের এক বিমান বন্দরে ৯০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে মানি লন্ডারিং আইনে ধরা পড়েছিলেন জয় এবং তার প্রাক্তন স্ত্রী।
২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নামে একটা প্রজেক্ট ছিল। এ প্রজেক্টের কাজ পেয়েছিলেন জয়ের বন্ধু বেইজ অন ম্যারিল্যান্ড। এই কোম্পানির সাব কন্টাক্ট পায় জয়ের কোম্পানি ওয়াজেদ কনসাল্টেন্ট। আপনি যদি চুরি না করে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট করতে চান, তবে খরচ হবে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশের প্রজেক্টটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে। জয় ৩০০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে ফেলেছিল কনসাল্টেন্সি ফি হিসেবে।
আওয়ামী লীগ করে নিউজার্সির বেস রহমান কনসালটেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে জয় অনেক টাকা সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছে। এছাড়া সজিব ওয়াজেদ জয় এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে লন্ডন, সিংগাপুর এবং হংক থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছে সজিব ওয়াজেদ জয়।
তবে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর কূটনৈতিকভাবে এসবের বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করে দেয়। ডকুমেন্টসগুলো ইতোমধ্যে দুই তিনজনের কাছে দেওয়া আছে। আমাকে যখন ধরা হয় তখন ২০১৩ সালের মে মাস। বাচার জন্য অনেক ডকুমেন্টস আমি নষ্ট করে ফেলি। তারপর অনেক ইনভেস্টিগেশন হয়ে গেছে। আমি এ বিষয়ে আর আগাইনি।
সিজার বলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকার আমার কাছে হাসিনা পরিবারের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে যে কোন সাহায্য সহযোগিতা চাইলে আমি করতে আগ্রহী।
তিনি বলেন, দেশে আমার বিরুদ্ধে জয়কে অপহরণের মামলা করেছিল সরকার। ২০১৮ সালে ইলেকশনের আগে এই মামলা করেছিল যাতে সাধারণ মানুষ জয়ের অর্থ পাচারের বিষয়ের দিকে না তাকায়।
সূত্র: দ্য মিরর এশিয়া
আপনার মতামত লিখুন :