স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়েছে। গতকাল বুধবার (১৩ নভেম্বর) পাকিস্তানের করাচি থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। নানা কারণেই পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজটির বাংলাদেশের বন্দরে ভেড়ার বিষয়টিকে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্ট ইউকের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশনের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধের পর এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়ল।
বাংলাদেশে পাকিস্তান হাইকমিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেয়ার করা এক পোস্টে বলা হয়েছে এই বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের করাচি থেকে একটি কার্গো জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। যা দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ।’
এতে আরও বলা হয়, ‘এই সরাসরি রুটটি সরবরাহ শৃঙ্খলা আরও সহজ করবে এবং পণ্য পরিবহনে সময় কমাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রায় ২ হাজার ৩০০টি (টুয়েন্টি ফিট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট বা ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কনটেইনার) ধারণক্ষমতার এই জাহাজটি বিভিন্ন ধরনের পণ্য বহন করে এনেছে। যা দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতিফলন।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ সরাসরি এই শিপিং রুটকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও ব্যবসায়িক সম্পর্কের উন্নয়নে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই উদ্যোগটি কেবল বিদ্যমান বাণিজ্যের গতি বাড়াবে না, বরং উভয় দেশের ব্যবসা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রপ্তানিকারকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।’
এদিকে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি কার্গো জাহাজের নোঙর করার বিষয়টি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রতীক। এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত জটিল কূটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতার নতুন দিগন্তের সূচনা করছে। সম্প্রতি ভারত ঘেঁষা শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এই উষ্ণতার সূচনা হয়েছে।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল। পরে সে বছর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ঘটে। নয় মাসব্যাপী এই সংঘাতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটে। যা ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ককে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবিত করেছে। ঢাকার অনেকেই পাকিস্তানকে এই গণহত্যার জন্য দায়ী করেন।
বছরের পর বছর বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সহায়তা করেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা করে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বশেষ, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর তিনি ভারতে চলে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ মুজিবের ছবি ও ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পর ইসলামাবাদ ও ঢাকা উভয়ই সম্পর্কে উষ্ণতা আনা এবং স্বাভাবিকীকরণে আগ্রহ প্রকাশ করে। গত সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে সাক্ষাৎ করেন। যেখানে তাঁরা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা পুনরায় চালু করার আহ্বান জানান।
দুই দেশের সম্পর্কে ‘নতুন অধ্যায়’ শুরু করার আহ্বান জানিয়ে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণের কথা উল্লেখ করে ড. ইউনূস সে সময় বলেছিলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক পুনর্জীবিত করা খুবই জরুরি।’
এই বিষয়টি শেখ হাসিনার প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে একটি বড় পরিবর্তন নির্দেশ করে। এর আগে, ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সরকার চীনে নির্মিত পাকিস্তানের নতুন যুদ্ধজাহাজ পিএনএস তাইমুরকে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙরের অনুমতি দেয়নি। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধজাহাজটি কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীর সঙ্গে মহড়ার পর শ্রীলঙ্কার একটি বন্দরে নোঙর করে।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ভারত বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসা, শক্তি এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার ভারত, এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার।
আপনার মতামত লিখুন :