ঢাকা রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ভ্যানে মরদেহের স্তুপ

আশুলিয়ায় গুলিবিদ্ধদের জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছিল পুলিশ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৪, ০৮:১০ পিএম

আশুলিয়ায় গুলিবিদ্ধদের জড়ো করে পুড়িয়ে দিয়েছিল পুলিশ

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের গা শিউরে ওঠা একটি ভিডিও। সেখানে দেখা যায় গুলিবিদ্ধ মরদেহ গুনে গুনে ভ্যানে তুলছে পুলিশ সদস্যরা।

পরে একটি পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে সেগুলো ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। মুহূর্তেই ফেসবুকজুড়ে ভাইরাল হওয়া ঘটনাটি কখন, কবে কিংবা কোথায় ঘটেছে তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নন।

শনিবার (৩১ আগস্ট) দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ঘটনার বিস্তারিত। ওই প্রতিবেদন বলছে, পুলিশের ভ্যানের মরদেহের স্তুপ করে রাখা মর্মান্তিক ঘটনাটি আশুলিয়া বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট সেখানকার ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের দেয়াল ঘেষে গুলিবিদ্ধ ৭ শিক্ষার্থীর মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল।

পরে পুলিশ সদস্যরা মরদেহগুলো একত্রিত করে ভ্যানের ওপর স্তুপ করে রাখে। পরে মরদেহগুলো থানায় পার্ক করা একটি পিকআপে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই ঘটনারই এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের ভিডিও এটি।

সেদিনের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী গণমাধ্যমকে জানান, গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপর বাইপাইল এলাকার বিজয় মিছিল বের হয়। বিকেলে উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করে। এ সময় আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে গেট বন্ধ করে দেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলে ও ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেট ভাঙতে এগিয়ে যান।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ এফ এম সায়েদ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। এতে আন্দোলনকারীরা আরও চড়াও হন। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেটে অবস্থান নেন। ওসি উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে তারা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। জবাবে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান।

এর একপর্যায়ে উপ-পরিদর্শক (এসআই) মালেক, ডিবির ওসি (তদন্ত) আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুর্মুহু গুলিতে আন্দোলনকারীরা দৌড়ে পালিয়ে যান।

থানার সামনের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি গণমাধ্যমকে বলেন, বিকেলে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে থানার গেটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেরিয়ে আসেন। তারা গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসেন।

তিনি আরও জানান, ভ্যানে মরদেহের স্তুপ করা জায়গাটি পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের গেটে। ওই গেইটের অপরপাশে সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারী এন্ড মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক ফাহিমা আক্তার বলেন, ঘটনাটি আমার দোকানের সামনেই ঘটেছে। ৫ আগস্ট বিকেলে সাড়ে ৪টা হবে। সেদিন গুলি খেয়ে থানার সামনে পড়ে থাকা মরদেহগুলো ভ্যানে তুলছিলেন পুলিশ। আমাদের চোখের সামনেই তুলেছে। প্রথমে মরদেহগুলো তুলে ব্যানার দিয়ে ঢেকে থানার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেই ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে।

ঘটনাস্থলে থাকা এক পোশাক শ্রমিক জানান, প্রথমে পলিমারস এন্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের সামনে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ ৭ জনকে একটি প্যাডেল ভ্যানে তুলে পুলিশ। পরে তাদের থানার সামনে এনে মরদেহগুলো পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয়। এরপরই তারা থানা থেকে বেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করে আর গুলি ছুড়তে থাকে। আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনের হাতে তখনো হাতকড়া ছিল।

আশুলিয়া থানার সামনে ওইদিন প্রাণ হারানোদের মধ্যে ছিল মধ্য জামগড়া শাহিন স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসশাবুর। তার বড় ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার পাশেই রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পরে পুলিশ তার নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পিকআপে ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। ভাইটি আমার জীবিত ছিলো নাকি মৃত সেটা জানার সুযোগও আমাদের হয়নি। আমার ভাইয়ের গায়ে নীল গেঞ্জি ছিল। আমরা গেঞ্জি দেখে পোড়া মরদেহ শনাক্ত করি।

বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডের এক অটোরিকশাচালক বলেন, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে ডান-বাম দু’পাশেই গুলি চালায়। গুলি চালাতে চালাতেই তারা নবীনগরের দিকে এগুতে থাকে। তখন মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালিয়েছে। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই তারা গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’পাশে পথচারী, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনো দেখেনি বাইপাইলবাসী।

সেদিন নিহতের স্বজন ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫ই আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে অন্তত ৩১ জন নিহত হন। পরদিন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৫ জন মারা যান। এতে ওই ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪৬ জন। এছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল, আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ।

আরবি/ এইচএম

Link copied!