ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আল–জাজিরার অনুসন্ধান

সাবেক ভূমিমন্ত্রীর যুক্তরাজ্যেই ৩৬০ বাড়ি, দুবাই–যুক্তরাষ্ট্রেও সম্পত্তি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪, ০৩:৫২ পিএম

সাবেক ভূমিমন্ত্রীর যুক্তরাজ্যেই ৩৬০ বাড়ি, দুবাই–যুক্তরাষ্ট্রেও সম্পত্তি

ছবি: সংগৃহীত

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর (জাভেদ) বিদেশে বিপুল সম্পদের খবর আগেই পাওয়া গিয়েছিল। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর তৎকালীন মন্ত্রী সেসব সম্পত্তিকে সম্পূর্ণ বৈধ বলে দাবি করেছিলেন।

কিন্তু এবার জানা যাচ্ছে, শুধু যুক্তরাজ্যেই তাঁর বাড়ি আছে ৩৬০টি! এর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা। বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২ কোটি মার্কিন ডলার। ডলারের বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি!

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম আল–জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি সম্প্রচার করে আল–জাজিরা।

আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল ‘আই ইউনিট’–এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান লন্ডনের বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএনই) দুবাইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৫৪টি সম্পত্তির মালিক হন। যুক্তরাষ্ট্রেও তাঁর সম্পত্তি আছে। সেখানে ৯টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এর মধ্যে ৫টি ম্যানহাটনসহ নিউইয়র্কের প্রধান প্রধান এলাকায় এবং ৪টি নিউ জার্সিতে।

নির্বাচনী হলফনামা এবং সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় যে পরিমাণ সম্পত্তির তথ্য এসেছিল, আল–জাজিরার অনুসন্ধানে দেখানোর সম্পত্তি তার চেয়ে ঢের বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান দেশের বাইরের এতো পরিমাণ সম্পদ তাঁর নির্বাচনী হলফনামা ও ট্যাক্স ফাইলে গোপন করেছেন।

আল–জাজিরা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডনে সাইফুজ্জামানের সম্পত্তিগুলো দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সাইফুজ্জামান সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণও নিয়েছেন। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও তাঁর সম্পদের বর্ণনা উঠে এসেছে।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিজেও তাঁর সম্পদ ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলকে বলেছেন। শেখ হাসিনা বিদেশে তাঁর ব্যবসা থাকার কথা জানতেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

সাইফুজ্জামানের বক্তব্যেই উঠে এসেছে, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সত্যি বলতে আমিও।’

বিলাসবহুল জীবনযাপনের গল্পও গর্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান। তিনি বলেছেন, তিনি পরেন টেইলর–মেডের (হাতে তৈরি) জুতা। হেরডসেও কাস্টম মেড (নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি) জুতারও অর্ডার দিয়েছেন। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। প্রতিটি ৩ হাজার পাউন্ডের বেশি দামে কিনেছেন বলে জানান তিনি।

এই বিশেষ জুতা তৈরির বিষয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়ায় তৈরি। সম্পূর্ণ বুকের চামড়ায় তৈরিগুলোর দাম ৬ হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম ৩ হাজার পাউন্ড। এটা খুবই ভালো। চার মাস লাগে তৈরি হতে!

স্যুট পছন্দ করেন জানিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, প্রতিবার তিনি লন্ডনে গেলে দু–তিন হাজার পাউন্ড স্যুট কিনতে খরচ করেন। সুপার ২০০, সুপার ১৮০—এগুলো কেনা হয়। সুপার ২০০–এর দাম ৬ হাজার পাউন্ড। কেনালি বন্ড স্ট্রিটে গিয়ে কেনেন সেগুলো। এরপর তারাই বাসায় পৌঁছে দেয়।

আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে থেকেই সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে অনুসরণ করছিল তাদের অনুসন্ধানী দল। তাঁর বেতন (বার্ষিক) ছিল ১৩ হাজার ডলার। অথচ তিনি যুক্তরাজ্যে বিপুল সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশে সাইফুজ্জামানের সম্পদের উৎস তাঁর ব্যবসা ও ইউসিবি ব্যাংকের শেয়ার। অনুসন্ধানী দল বিদেশে তাঁর সম্পত্তির খোঁজ করতে গিয়ে চমকে যায়!

লন্ডনে বাড়িগুলো তৈরির বিষয়ে আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কেনেন। তাঁর বাড়িগুলোর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনা।

শুধু তা–ই নয়, ২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও সম্পদ কেনেন তিনি। তাঁর বেশিরভাগ বাড়িই ভাড়া দেওয়া। ২০২০ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার।

রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্যে কঠোর যাচাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এই বাধা এড়াতে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে সহায়তা করেছেন তাঁর সহযোগী রিপন মাহমুদ। রিপন আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের গ্রাহকের (সাইফুজ্জামানের) লন্ডনে ৩০০টি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য ২০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেন তিনি।’

সাইফুজ্জামানও বলেছেন, লন্ডন ও যুক্তরাজ্যের সব সম্পত্তি রিপনের মাধ্যমেই তিনি কিনেছেন।

সাইফুজ্জামানের টাকা পাচারের কৌশল সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছেন এই রিপন মাহমুদ। আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল বিনিয়োগকারীর হিসেবে চীন থেকে ১০ কোটি ডলার যুক্তরাজ্যের বাজারে স্থানান্তর করার বিষয়ে রিপনের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

এই সূত্রে আলাপচারিতায় রিপন তাঁর কাজ ও দক্ষতার দৃষ্টান্ত হিসেবে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রসঙ্গ টানেন। রিপন বলেন, ‘আমার ভালো বন্ধু সাইফুজ্জামান। আপনি যেটা আমার কাছে চাচ্ছেন, সেটাই আমি তাঁর (সাইফুজ্জামান) জন্য করেছি।’ তাঁর পরিচয় সম্পর্কে রিপন বলেন, ‘তিনি একজন ক্ষমতাধর মন্ত্রী। তিনি বুদ্ধিমান। তিনি বড় প্রকল্পে যান না। যখন আপনি বড় প্রকল্পে যান, কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে যায়। বড় টাকা, বড় সংখ্যা সবাইকে সতর্ক করে দেয়। আপনি বুঝতেই পারছেন কী বলছি। তিনি এক কোটি আনেন এবং বলেন, আমি নগদে কিনিনি। ব্যাংক আমাকে টাকা দিয়েছে।’

কয়েক দফা সাক্ষাতের পর রিপন স্বীকার করেন, তাঁর সবচেয়ে বড় গ্রাহক সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ থেকে আসছেন। চার বছর আগে তাঁর জন্য সবকিছু ঠিক করেছেন। প্রতিবছর তিনি (সাইফুজ্জামান) তাঁর মাধ্যমে ১০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেন।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী বাংলাদেশে ফেরত আসার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করে আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল। এর আগে রিপনের পরামর্শে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরামর্শকদের সঙ্গে দেখা করে দলটি। প্রথমেই সাইফুজ্জামানের আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করে অনুসন্ধানী দল। ওই আইনজীবী একটি কোম্পানির মানি লন্ডারিং রিপোর্টিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। যার কাজ হচ্ছে কোম্পানির আইনকানুন নিশ্চিত করা। ২০২১ সাল থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানের ১০০টির বেশি ঋণের আইনের কাজগুলো করেছেন তিনি।

এরপর রিপন পরিচয় করিয়ে দেন এশিয়ার বৃহত্তম ব্যাংক ডিবিএসের রাহুল মার্টের সঙ্গে। রাহুলের পেশা ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবস্থাপনা। রিপন বলেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে ব্যাংকের গ্রাহক করতে গিয়ে রাহুল কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সিঙ্গাপুরের ব্যাংকটিতে অত্যন্ত কড়াকড়ি থাকায় তাঁর স্ত্রীকে এর গ্রাহক করা হয়েছিল।

২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে ডিবিএস সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কোম্পানিগুলোকে ২০টি ঋণ দেয়। রিপন অনুসন্ধানী দলকে মার্কেট ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশনের সিইও পারেশ রাজার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি সাইফুজ্জামানের জন্য শত শত ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী তাঁর মোট সম্পত্তির এক–চতুর্থাংশ, ৮০টির বেশি যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বার্কলি হোমস থেকে কিনেছেন। বার্কলি হোমসের একটি বিপণন অনুষ্ঠানে আল–জাজিরার একজনকে রিপন বলেন, তাঁর ৩০০–এর বেশি বাড়ি আছে। তিনি দুবাইয়ে এগুলো তাঁর (সাইফুজ্জামান) জন্য কিনেছেন।

দুবাইয়ের সূত্র অনুসরণ করে নতুন আরও অনেক সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। দুবাইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৫৪টি সম্পদের তালিকাভুক্ত মালিক হন সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

এরপর রিপনকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সাইফুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর লন্ডনের বাড়িতে সাক্ষাৎ করে অনুসন্ধানী দল। সেখানে সাইফুজ্জামান জানান, তিনি ব্যবসা থেকে তাঁর সব লাভ দুবাই ও লন্ডনে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুবাইয়ে ডাউনটাউনে আমি সেরা সম্পত্তি পেয়েছি। দুবাই মলের কাছে অপেরা এলাকায় আমার খুব সুন্দর একটি প্যান্ট হাউস আছে। আমি একটি ভিলাও কিনেছি, যার একটায় ব্যক্তিগত হ্রদ আছে। সবকিছু আছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি আছে। ম্যানহাটনে (যুক্তরাষ্ট্র) আমার খুব সুন্দর সম্পত্তি আছে।’

বাংলাদেশ থেকে এতো টাকা কীভাবে আনলেন, এ প্রশ্নের জবাবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমার দুবাইয়ে রিয়েল স্টেট কেনাবেচার ব্যবসা আছে। দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি। এরপর এখান থেকে একটা ঋণ নিই।’

আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। সাইফুজ্জামানের বর্তমান অবস্থান অজানা। তবে বাংলাদেশ ছেড়েছেন বলে একটি কথোপকথনে তিনি উল্লেখ করেছেন।

আরবি/ এইচএম

Link copied!