# গণতান্ত্রিক পরিবেশে পরবর্তী ইউপি নির্বাচন। অংশ নিতে পারবে না গণহত্যায় অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল-নেতা। বৃহস্পতিবার অনুমোদন হলে রাতেই প্রজ্ঞাপন।
# স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক সেবা ব্যাহত হওয়ায় অপসারণের সিদ্ধান্ত।
# প্যানেল চেয়ারম্যান বা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকায় পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ১২ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনুপস্থিত থাকায় এবার একই পরিস্থিতি হতে যাচ্ছে দেশের বেশিরভাগ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদের। পালিয়ে থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক সেবা ব্যাহত হওয়ায় তাদেরও অপসারণ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এ-সংক্রান্ত একটি বিল উত্থাপিত হচ্ছে আগামী বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিতব্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। এদিন বিষয়টি অনুমোদন পেলে রাতেই জারি হতে পারে প্রজ্ঞাপন। স্থানীয় মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সারা দেশে ৪,৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এসব ইউনিয়নে প্রায় দুই বছর বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া এক তরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৮ সালের পর স্থানীয় সরকারের সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসছে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে গত ৬ বছরে হাতেগোনা কিছু ইউনিয়ন, উপজেলা বাদে বেশিরভাগেই জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের। যদিও তারা সবাই এখন পলাতক। কেউ কেউ আটক হয়ে রয়েছেন কারাগারে। এসব নির্বাচনে ভয়াবহ অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল সর্বত্র। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে নেওয়া সংস্কারে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। এটা হলে পরবর্তী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি), পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র এবং উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সারা দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে শতভাগ গণতান্ত্রিক পরিবেশে। তবে এসব নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না গণহত্যায় অংশ নেওয়া কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতা।
গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয় এবং দেশ থেকে পালিয়ে যায়। মূলত এর পরপরই বিনা ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের অপসারণের দাবি ওঠে। মাঠপর্যায় থেকে ওঠা এ দাবির প্রতি সমর্থন জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। একে একে পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ১২ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও রয়েছেন পলাতক। কেউ কেউ আটক হয়ে রয়েছেন কারাগারে। বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সারা দেশের ইউপি কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকা ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে প্যানেল চেয়ারম্যান কিংবা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে এখন বিষয়টি চূড়ান্ত করতে পাঠিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। তৃণমূলে সাধারণ নাগরিকদের সেবার কথা বিবেচনা করে এতদিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশের ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় সব চেয়ারম্যানরাই রয়েছেন পলাতক। পলাতক চেয়ারম্যানরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। পদের বদৌলতে বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেন এসব নেতা। আর নির্বাচিত হয়ে অপকর্মে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। এরা সবাই এখন আত্মগোপনে চলে গেছেন।
ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতির বিষয়ে গত মাসে সরকারের জারি করা এক পরিপত্রে বলা হয়, দেশের যেকোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে জনসাধারণের সেবাকাজ বিঘ্নিত হলে সেখানে বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্যানেল চেয়ারম্যানদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করবেন। আর প্যানেল চেয়ারম্যানরাও অনুপস্থিত থাকলে সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) এসব ক্ষমতা অর্পণ করবেন।
স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদের আইন অনুযায়ী, পদত্যাগ করলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যপদ শূন্য হবে। এছাড়া পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কারণে চেয়ারম্যান পদ শূন্য হলে নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবেন। তবে শূন্য হওয়া ছাড়াও আইন অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি বা দণ্ডিত হলে, পরিষদের স্বার্থ পরিপন্থি কাজ করলে চেয়ারম্যানদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে সরকার। এ ছাড়াও দুর্নীতি, অসদাচরণ বা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ কিংবা বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ আইন অনুযায়ী তাদের অপসারণ করার ক্ষমতা রয়েছে সরকারের। ইতিমধ্যে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যানরা বিগত হাসিনা সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট। তাদের পরোক্ষ সহায়তায় অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করার সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত থাকতে পারে। বিভিন্ন স্থানে যেসব সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে এইসব ইউপি চেয়ারম্যানদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।’ তাদের দ্রুত অপসারণের দাবি জানান তিনি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞ আবু আলম শহীদ খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে এমন সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে যে, নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, হতাশা রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে মানুষ এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তাদের অপসারণ চাইছে। এটা বাস্তবায়ন করা বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। বর্তমান সরকার অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে যেমনটি করেছে, ঠিক একইভাবে ইউনিয়ন পরিষদের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’ গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের সংস্কারের দাবিগুলো উত্থাপন করা দরকার নির্বাচিত সরকারের কাছে। জাতীয় থেকে স্থানীয় সরকার সব পর্যায়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। দলীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ কর্তৃত্ব, জনবল, আর্থিক সামর্থ্য ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে স্থানীয় জনগণকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়। বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো অত্যন্ত প্রকট।’ বিষয়টি নিয়ে সচিবালয়ে ঢাকা জেলায় কর্মরত এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বেশিরভাগ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ এলাকায় অবস্থান করলেও দপ্তরে আসছেন না। একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সব ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা খুবই কঠিন। তাছাড়া অভাব রয়েছে জনবলের।
আপনার মতামত লিখুন :