ঢাকা শনিবার, ০৪ জানুয়ারি, ২০২৫

উত্তরায় বায়ুদূষণের ঝুঁকি প্রজনন স্বাস্থ্যে

তরিক শিবলী, উত্তরা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৫, ১২:২২ এএম

উত্তরায় বায়ুদূষণের ঝুঁকি প্রজনন স্বাস্থ্যে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

প্রতি বছর শীতের সময় বায়ুদূষণ বাড়লেও এবার শীত শুরুর বেশ আগে থেকেই উত্তরায় দূষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। দূষণের দিক থেকে প্রায়ই প্রথম হচ্ছে উত্তরা এবং যা এখনো চলমান। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে গত দুই মাসে উত্তরা একাধিকবার ৩০০-এর একিউআই স্কোর নিয়ে সর্বোচ্চ দূষিতের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। 

অথচ কোনো স্থানের একিউআই স্কোর যদি ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকে, তবে তা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। এমনকি, এই একিউআই স্কোর যদি পরপর তিন ঘণ্টা ৩০০-এর বেশি থাকে, তবে সেখান স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করা হয়। এই অতিরিক্ত বায়ুদূষণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজননক্ষমতার ওপর। 


বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) জরিপে এ তথ্য পাওয়া গেছে। যেখানে বায়ুতে অতি ক্ষুদ্র কণার মাত্রা বাংলাদেশের আদর্শ মান প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের চাইতে চার-পাঁচগুণ বেশি। এই অতি ক্ষুদ্রকণা বলতে ২.৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের বস্তুকণার কথা বলা হচ্ছে। একটি চুলের সাথে তুলনা করলে এসব ধূলিকণার আকার চুলের প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগের সমান, যা সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে।


বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে, তার অধিকাংশই বায়ুদূষণজনিত। বায়ু গবেষক ইসরাত জাহান বলেন, সাম্প্রতিককালে বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে বসবাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। বিশেষ করে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ুদূষণ বড় ধরনের প্রভাব ফেলে বলে জানান চিকিৎসক নিজামুল হক। 


তিনি বলেন, বায়ুদূষণে সার্বিকভাবে পরিবেশদূষণে এক ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর। এতে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে, শুক্রাণুর মান কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে মেয়েদের ডিম্বাণু কল্পনাতীতভাবে কমে গেছে। আবার যেসব ডিম্বাণু রয়েছে, সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব দুর্বল বা নষ্ট ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর যখন নিষেক ঘটে, এতে যে ভ্রƒণ তৈরি হয়, সেটা গর্ভে জায়গা করতে পারে না, আবার জায়গা করতে পারলেও বাঁচে না, গর্ভপাত হয়ে যায়। আর এই সমস্যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বর্তাতে পারে। 

এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণ সময়ের আগে কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুদের ব্যাপক ক্ষতি করে। শিশুর মধ্যে অস্থিরতা, ঘুম কম হওয়া, খিটখিটে স্বভাব ও শিশুর বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্তেও বায়ুদূষণ বিশেষভাবে দায়ী। বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যানসার, দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা, হৃদ্যন্ত্র, চোখ, ত্বক, কিডনি ও প্রজননক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


এ বছরের নভেম্বর থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ছয় দিনের মাঝে যে কোনো একদিন কোনো না কোনো সময়ে উত্তরা দূষিত নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং তার বায়ুর মান সূচক ৩০০-এর ওপরে থাকছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানান, গত ১০ বছরের চেয়ে এই বছর ১০ গুণের বেশি বায়ুদূষণ বেড়েছে, যা একটা শঙ্কার বিষয়। 

আগের কয়েক বছরের ধরন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বায়ুর মান এতটাই খারাপ থাকে যে এই পাঁচ মাসে সারা বছরের প্রায় ৬৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। আগের সব রেকর্ড ভেঙে বারবার দূষণের তালিকার শীর্ষে উত্তরা চলে আসার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। 


উত্তরায় সারা বছরই ছোট-বড় অজস্র ভবন নির্মাণ এবং রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। এর পাশাপাশি গত কয়েক বছরে যোগ হয়েছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প। যেকোনো ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম মানা হয় না। 


ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম পালন করা না হয়, সেক্ষেত্রে ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি জরিমানা আরোপ করতে পারবে সিটি করপোরেশন। পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব নিয়ম কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। 

উত্তরা, খিলক্ষেত, আব্দুল্লাপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখানসহ পুরো উত্তরায় এই নিয়মের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাওয়া যায়নি। উত্তরাকেন্দ্রিক অনেকগুলো মেগা প্রজেক্ট আছে। সেগুলোতে যখন পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ প্রতিবেদনটি অনুমোদন দেওয়া হয় এবং ছাড়পত্র দেওয়া হয়, তখন সেখানে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু দিকনির্দেশনা থাকে। কিন্তু ওগুলো প্রতিপালিত না হলে সাইটে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার মতো সাহস পরিবেশ অধিদপ্তর দেখায় না।


মানবাধিকার আইন সালিশ ও পরিবেশ রক্ষা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ এনামুল হক নিপু বলেন, আপনি রাস্তা বানাতে গিয়ে যদি মানুষকে ফুসফুসের ক্যানসার দিয়ে দেন, তাহলে তো সে মরেই যাবে। রাস্তায় চলাচল করবে কখন? পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, এমনকি জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরÑ কেউ আইনকে কার্যকর করার ব্যাপারে নজর দিচ্ছে না। 


উত্তরায় বায়ুদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। উত্তরায় এবং উত্তরখান ও দক্ষিণ খানে, ছোট-বড় হাজার শিল্প কারখানা আছে, যেগুলো দূষণের অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ইটভাটা এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চলছে। এসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা, কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে এটা থেকে প্রচুর ছাই তৈরি হয় এবং কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসের সাথে মেশে। 


এ ছাড়া, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের শিল্প কারখানাও গড়ে উঠছে উত্তরায়। ক্যাপসের ওই গবেষণা অনুযায়ী, দেশের বায়ুদূষণের ৫০ শতাংশেরও বেশি ঘটে শিল্পকারখানা থেকে। বাংলাদেশের মাটির ধরনের কারণে এখানের বাতাসে সব সময় ধুলাবালু ছিল। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এই ভূখণ্ডের বাতাস মানুষের জন্য এতটা ক্ষতিকর ছিল না। 

উত্তরায় যেকোনো রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই দেখা যাবে, চারপাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে বিকট শব্দে ছুটে চলছে বিভিন্ন ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বিশেষ করে লেগুনা বাস ও ট্রাক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উত্তরায় এখনো ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার কারণে। রাস্তায় যখন মোবাইল কোর্ট থাকে, তখন রাস্তায় আর গাড়ি থাকে না। ফলে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি গণপরিবহন রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। 

ঢাকার সড়ককে ফিটনেসবিহীন যানবাহনমুক্ত করার জন্য পরিচালিত মোবাইল কোর্টের বিষয়ে মন্তব্য করেন পরিবেশবিষয়ক কর্মী সৈয়দা তামান্না হক তমা। এই গাড়িগুলোর যে ফিটনেস নেই, তা বোঝার জন্য গবেষণা করা লাগে না, এগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কিন্তু কোনো এক রহস্যজনক কারণে এগুলো এখনো রাস্তায় চলে। বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থার কথা তুলে ধরে মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের ৫৩ বছরে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত হচ্ছে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট খাত।’

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!