রাজধানী উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে জামাইবাজার নামে অবৈধ একটি মেলা পরিচালিত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দ্বারা পরিচালিত হতো বউবাজার। পুরোনো জিনিস নতুনভাবে ভোল পালটে এখন বিএনপির নেতাকর্মী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে জামাইবাজার নামে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজউকের প্রায় ১৩০ কাঠা জায়গা দখল করে জামাইবাজার পরিচালিত হচ্ছে। মূল পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপির নেতা মোখলেছ।
১৫ নম্বর সেক্টরের স্থানীয় বাসিন্দা মমিনুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখানে যা হয়, তা সভ্য কোনো মানুষের পক্ষে করা উচিত নয়। মেলার চারদিক দিয়ে যুবক-যুবতীরা বিভিন্ন নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে। উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা দেখলে মনে হয় যেন কোনো সভ্য সমাজে আমরা নেই। আপনারা সাংবাদিকেরা যদি সত্য লেখেন, তাহলে এটাই লেখেন- আগে আওয়ামী লীগ খাইত, এখন বিএনপি খায়।
এই মেলায় ফুড কর্নার রয়েছে সাকল্যে ১৬০টি। এসব ভাসমান দোকানের জন্য প্রদান করতে হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। ফুটকোর্ট থেকে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ লাখ টাকা। প্রতিদিন প্রতিটি দোকানকে দিতে হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, এতে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয় ৭২ হাজার টাকা। মেলায় তিনটি রাইড থেকে প্রতিদিন টাকা তোলা হয় ৩০ হাজার। সাকল্যে মেলায় ৩০ দিনের হিসাব করলে চাঁদার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
ফুডকোর্টের এক নারী ব্যবসায়ী সুমি আক্তার বলেন, ১৫ হাজার টাকা দিয়ে এই ভাসমান দোকান নিয়েছি। প্রতিদিন আমাকে দিতে হয় ৪০০ টাকা। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশের কারণে যেকোনো সময় প্রশাসনের লোক এসে বন্ধ করে দিতে পারে।
এখানে বিদ্যুৎ লাইন থেকে শুরু করে সবকিছুই অবৈধ। কিছুদিন যাবৎ নতুন যোগ হয়েছে দামি দামি গাড়ি, হোন্ডা নিয়ে বেশ কিছু মানুষ এখানে এসে নেশাজাতীয় দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় করে।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, পুরো মেলার জন্য যে আলোকসজ্জা করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে। এ বিষয়ে ডেসকো প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুরুজ্জামান হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আগে অভিযান চালিয়ে এটা বন্ধ করেছি, এখন আবার ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা করা হবে। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি আপনার মাধ্যমেই জানতে পারলাম।’
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে আমরা দেখছি। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমি আজই ব্যবস্থা শুরু করছি। যখন অভিযান চালাব, তখন অবশ্যই রূপালী বাংলাদেশকে জানানো হবে।’
প্রতিদিন জামাইবাজার ঘিরে ১৫০টির অধিক গাড়ি ও পাঁচ শতাধিক মোটরসাইকেল মেলা প্রাঙ্গণে ভিড় করে। প্রায় ১৫ হাজার মানুষের সমাগম হয় এখানে। কিন্তু গত মঙ্গলবার ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একটি পুলিশের টহল গাড়িও দেখা যায়নি।
মেলার আরেক দোকানের মালিক আমিন বলেন, পুলিশ আসবে কীভাবে, প্রতি দোকানদারই তো পুলিশের জন্য প্রতিদিন টাকা দেয়। টাকা পাইলে পুলিশ সবই করতে পারে।
এই অবৈধ স্থাপনা, বিদ্যুৎ সংযোগ, আইনশৃঙ্খলা- সবকিছু মিলিয়ে তুরাগ থানার ওসি মোহাম্মদ রাহাত খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার আওতাধীন এলাকায় কোনো অবৈধ কাজ করার সুযোগ নেই। ছোটখাটো বিভিন্ন দোকান বসে, তা দেখেও দেখি না; গরিব মানুষের পেটে লাথি দিয়ে লাভ কী? তবে এত বড় আয়োজন যদি হয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে উত্তরা ১৫ নম্বর কল্যাণ সমিতির কাছে জানতে চাইলে কল্যাণ সমিতির ম্যানেজার তারেক মাহমুদ বলেন, ‘যুবদল নেতা পরিচয়ে মোখলেস নামের একজন এখানে আসে। কোনো প্রকার অনুমতি এবং কোনো কাগজপত্র না থাকায় কল্যাণ সমিতি থেকে কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। তার সঙ্গে আসা নেতাকর্মীরা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে।’
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম-পরিচয় না দেওয়ার শর্তে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি, খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেব। তাদের উচ্ছেদ করার জন্য ইতিমধ্যে ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।’
মেলার সংবাদ সংগ্রহ করার সময় কথিত এক বিএনপি নেতা আলামিন রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে স্বেচ্ছায় কথা বলতে এসে প্রতিবেদককে বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নাম ও পরিচয় দিয়ে কথা বলার অনুরোধ করেন। কিন্তু তার কাছে অনুমতিহীন এই মেলা সম্বন্ধে বারবার জানতে চাইলে তিনি একপর্যায়ে বলেন, ‘আমি মেলা দেখাশোনা করি, অর্থ লেনদেন সম্বন্ধে আমার কিছু জানা নাই। তবে টাকা তো অবশ্যই নেওয়া হয়, টাকা ছাড়া কোনো কিছুই হয় না। মোখলেস ভাই এই মেলার মালিক, উনি সবকিছু পরিচালনা করেন। আপনি ওনার সাথে যোগাযোগ করেন।’
পরে মেলার অবৈধ স্থাপনা এবং প্রায় এক মাসে ১ কোটি টাকা চাঁদার বিষয়ে বিএনপির নেতা মোখলেসের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো টাকাই নেওয়া হয় না, শুধু বিদ্যুৎ বিল নেওয়া হয়। আগের বউবাজারের লোকরা এখানে এসে বাজার খুলেছে। আর আমি দুইটা প্লট ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছি। আপনি আসেন একদিন, এসে সন্ধ্যার সময় দেখা করেন, একসাথে চা খেতে খেতে কথা বলি। অনেক সাংবাদিকই আমার সাথে দেখা করে।’
উল্লেখ্য, রাজধানী উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে আগে ছিল অবৈধ মেলা বউবাজার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দ্বারা পরিচালিত বউবাজারটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের সহযোগিতায় বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত ২১ আগস্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাসিকের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযানটি পরিচালনা করা হয়। সে সময় রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদককে তিনি বলেন, সন্ধ্যায় এখানে নেশাগ্রস্তদের আনাগোনা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ ফুডকোর্টসহ দোকান রয়েছে। প্রতিটা জিনিস এখানে অবৈধ।
আপনার মতামত লিখুন :