ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৪
ঘটাতে পারে প্রজাতির বিলুপ্তি

বাংলাদেশের বনে পাওয়া গেল সংকর হনুমান

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪, ০২:৫৭ পিএম

বাংলাদেশের বনে পাওয়া গেল সংকর হনুমান

ছবি: সংগৃহীত

দিন যত যাচ্ছে প্রকৃতি তত বিপর্যস্ত হচ্ছে, এতে করে ঝুঁকিতে পড়ছে বন্যপ্রাণী। আর এই অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের মূল কারিগরই হচ্ছে মানুষ। এর নতুন একটি প্রমাণ মিলেছে সিলেট বিভাগের বনাঞ্চলে। সেখানে চশমাপরা হনুমান এবং মুখপোড়া হনুমানের মিশ্র প্রজাতির দলের পাশাপাশি শনাক্ত হয়েছে সংকর হনুমান। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে প্রজাতিগুলোর একটি বা দুটিই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতে।

সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, ‘স্প্রিঞ্জার নেচারে’র ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব প্রাইমেটোলজিতে।

২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চালানো হয় গবেষণাটি। গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের বাংলাদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং আইইউসিএন প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য তানভীর আহমেদ। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন বনে হনুমানের ৯৮টি দলের ওপর জরিপ চালান তাঁরা। এ সময় আটটি মিশ্র দলের খোঁজ পান। অর্থাৎ এগুলোতে চাশমাপরা এবং মুখপোড়া দুই জাতের হনুমানই ছিল। এদের মধ্যে তিনটি দলের কয়েকটি প্রাণীর চেহারায় দুই প্রজাতির প্রাণীর মিশ্রণ লক্ষ্য করেন। কিন্তু সংকরায়ণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিনগত পরীক্ষা জরুরি।

গবেষকেরা তিনটি মিশ্র দলের তিনটি সম্ভাব্য সংকর হনুমানকে চিহ্নিত করেন। এটা করা হয় চেহারা অর্থাৎ শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখে। এদের দুটি ছিল হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে এবং একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। সম্ভাব্য সংকরগুলোর মধ্যে একটি হনুমানটি পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী হনুমান। গবেষকেরা বুঝতে পারেন এর একসময় বাচ্চাও ছিল এবং বাচ্চাকে নিয়মিত দুধ পান করত। বাকি দুটি সম্ভাব্য সংকর হনুমান অপ্রাপ্তবয়স্ক।

সংকরায়ণের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে সংগৃহীত মলের নমুনার জিনগত পরীক্ষা করা হয় জার্মানির জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষণাগারে। আর এতেই একটি সংকর হনুমানের বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য মেলে। ২০২৩ সালে সাতছড়ির একটি মিশ্র দলে জন্মানো এই সংকর হনুমান শিশুর বাবা চশমাপরা হনুমান এবং মা মুখপোড়া হনুমান। এদিকে সংকর বলে অনুমান করা ওই স্ত্রী হনুমানটির আবিষ্কার থেকে ধারণা করা হচ্ছে অন্তত স্ত্রী সংকর হনুমানেরা বাচ্চা দানেও সক্ষম।

জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষকেরা ছাড়াও ১৫ সদস্যের এই গবেষক দলে আছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাবির বিন মুজাফফার, ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের প্রধান গবেষক মো. সাবিত হাসান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী, স্থানীয় ইকো-গাইড এবং বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী। বাংলাদেশ বন বিভাগের অনুমতিতে মাঠ পর্যায়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত।

আইইউসিএন লাল তালিকায় চশমাপরা হনুমান বিশ্বব্যাপী বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণী। এদের বিস্তৃতি বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে মিয়ানমারের ইরাবতী নদী পর্যন্ত।

এদিকে মুখপোড়া হনুমান বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন এবং বাংলাদেশে বিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণী। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান, মিয়ানমার এবং চীনের সামান্য কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু পাহাড়ি বনে এই দুই হনুমান প্রজাতির বসবাস। এ ছাড়া মধুপুরের পাতাঝরা বনেও মুখপোড়া হনুমান আছে। বনের লতাপাতা, ফুল-ফল, কীটপতঙ্গ এদের প্রধান খাবার। খাবার গ্রহণ ও পরবর্তীতে মলের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের বীজ বনে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে হনুমানেরা। অর্থাৎ বনের বিস্তারে ভূমিকা রাখে হনুমানেরা।

গবেষকেরা সিলেটের বিভাগের লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা, রাজকান্দি, পাথারিয়া এবং অতোরা সংরক্ষিত বনে হনুমানের এই দলগুলোর ওপর জরিপ করেন। মিশ্র প্রজাতির হনুমানের দলগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয় প্রায় ৪ বছর ধরে।

তানভীর আহমেদ গবেষণার পটভূমি তুলে ধরে জানান, ১৯৯৭-৯৮ সালে চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গা বনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মফিজুল কবির পিএইচডি গবেষণার সময় প্রথম চশমাপরা হনুমান এবং মুখপোড়া হনুমানের দুইটি অস্থায়ী মিশ্র-প্রজাতির দলের খোঁজ পান। তবে সেগুলোতে কোনো সংকরের উপস্থিতি ছিল না। প্রায় দুই দশক পর ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে একটি সম্ভাব্য সংকর হনুমান দেখে বিস্মিত হন তাঁরা। এর আগে এই দুই প্রজাতির হনুমান মিলে সংকর হনুমান জন্মানোর কোনো বৈজ্ঞানিক ইতিহাস নেই বলেও জানান তিনি।

তানভীর আহমেদ বলেন, গবেষণায় দেখা যায় লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে হনুমানের ঘনত্ব রাজকান্দি, পাথারিয়া এবং অতোরা সংরক্ষিত বনের তুলনায় অনেক বেশি। তবে দেশের সুরক্ষিত বনগুলো আকারে ছোট এবং একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ফলে প্রাণীগুলো ক্রমেই নির্দিষ্ট অঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে এবং জিনগত আদান-প্রদানের সুযোগ কমে যাচ্ছে।

গবেষণাপত্রটিতে উল্লেখ করা হয়, প্রাইমেটদের মধ্যে সংকরায়ণের ঘটনা একেবারেই কম। এ ধরনের দুটি প্রজাতির বিচরণের এলাকা একই হয়ে গেলে এ ঘটনা ঘটতে পারে। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন বন উজাড়, বনগুলোর মধ্যে সংযোগ নষ্ট, শিকার এবং ফাঁদে ফেলে বন্যপ্রাণী ধরা এদের সংখ্যা কমানোয় ভূমিকা রাখে। এতে এই ধরনের সংকরায়ণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘প্রজনন সক্ষম সংকরের অস্তিত্ব বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কারণ দুটি বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে জিন প্রবাহ তাদের ভবিষ্যতের জেনেটিক গঠনকে প্রভাবিত করতে পারে বলে ধারণা দেয়।’

এদিকে গবেষক দলের উপদেষ্টা ক্রিস্টিয়ান রোস বলেন, ‘এটি শুধু স্থানীয় সমস্যা নয়। আবাসস্থল ধ্বংস হলে, প্রাণীরা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে মিশে যায় এবং মিশ্র দল গঠন করে। এতে সংকরায়ণ ঘটতে পারে। এটি এমনকি একটি বা উভয় প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটাতে পারে।’

গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে ভালোভাবে সংরক্ষিত বনে সংরক্ষণে কম মনোযোগ দেওয়া বনের তুলনায় হনুমানের সংখ্যার ঘনত্ব বেশি। তবে এই বনগুলো বেশির ভাগই ছোট এবং একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রজাতিগুলোর দীর্ঘমেয়াদি বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার তুলনায় খণ্ড ভণ্ড বন এগুলো।

‘বন সংরক্ষণ একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হতে হবে। আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নিই, তাহলে শুধু দুটি বানরের প্রজাতিই নয়, বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশও হারাতে পারি।’ বলেন তানভীর আহমেদ।

গবেষণার সহ-লেখক ডিটমার জিনার গোটা বিষয়টির সারসংক্ষেপ তুলে ধরে বলেন, ‘এই গবেষণাটি আমাদের জাগিয়ে তোলার একটি বার্তা। কার্যকর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ কৌশল বিকাশের জন্য আরও তথ্য প্রয়োজন। আরও গবেষণা আমাদের সংকরায়ণের মাত্রা, মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রভাব এবং কীভাবে এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাবগুলি প্রতিরোধ করা যায় তা বুঝতে সাহায্য করবে।’

গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশ অর্থাৎ সিলেট বিভাগে এখন ৫০০-র কম চশমা হনুমান এবং ৬০০ মুখপোড়া হনুমান আছে। অর্থাৎ এই প্রজাতিদের রক্ষায় সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে।

বেশীরভাগ হনুমানের আবাস্থল মানবসৃষ্ট কারণ যেমন বনের জমি দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ, কৃষিকাজ, কাঠের জন্য উদ্ভিদের চাষাবাদ, গাছ চুরি, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। তা ছাড়া বন্যপ্রাণীর অবৈধ শিকার-বাণিজ্য, বিদ্যুতায়িত হওয়া ও গাড়িচাপায় মারা যাওয়াসহ নানা কারণে হনুমানের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

এদের বেঁচে থাকা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে বলেও জানানো হয় গবেষণাপত্রে। এর মধ্যে রয়েছে বন সংরক্ষণ এবং খণ্ড বনগুলোর মধ্যে যোগাযোগের জন্য করিডর তৈরি করা।

আরবি/ এইচএম

Link copied!