প্রায় ১৫ লাখ বছর আগে কেনিয়ার লেক তুরকানের কাছের একটি অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল। এসময় ‘হোমিনিন’ নামের দুই প্রজাতি একই সঙ্গে বিচরণ করছিল। প্রাচীন এই হ্রদের তীরে একই সময়ে তৈরি হওয়া দুটি আলাদা হোমিনিন প্রজাতির পদচিহ্নের জীবাশ্মগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে এই তথ্য জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা।
মানব বিবর্তন এবং প্রজাতিগুলো টিকে থাকতে কীভাবে একে অপরকে সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতা করেছিল তা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা প্রদান করবে এই আবিষ্কার। দুটি সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতির হোমিনিন হয়তো খাবারের জন্য সেখানে সহাবস্থান করছিল।
‘হোমিনিন’ একটি নতুন শব্দ যা ‘হোমিনিড’ নামক বৃহত্তর শ্রেণির একটি উপ-বিভাগ। হোমিনিনে মৃত এবং জীবিত সব ধরনের জীব অন্তর্ভুক্ত। এটি মানব বংশধর হিসেবে বিবেচিত, যারা গ্রেট এপস (বানর) এর পূর্বপুরুষদের থেকে পৃথক হওয়ার পর মানবজাতির শাখা হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে। এটি ধারণা করা হয় যে, এই বিভাজনটি প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ বছর আগে ঘটেছিল।
গবেষণাটি ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি প্রমাণ করে, বিভিন্ন হোমিনিন প্রজাতি একই সময়ে এবং একই অঞ্চলে বসবাস করেছিল। তারা শিকারি প্রাণী থেকে বাঁচতে এবং প্রাচীন আফ্রিকান পরিবেশে খাদ্য নিরাপদে সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে একে অপরের সঙ্গে একই সময়ে সহাবস্থান করেছিল। গবেষকেরা জানান, হোমো ইরেকটাস এবং পারানথ্রোপাস বইসেই প্রজাতির হোমিনিনরা এই পদচিহ্নগুলো তৈরি করেছিল। এগুলো পলাইস্টোসিন যুগের দুটি অন্যতম সাধারণ মানব প্রজাতি ছিল।
১৯৮১ সাল থেকে কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলের ওই অঞ্চলটিতে গবেষণা করেন গবেষক ফেইবল। এই স্থানটি একটি ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ জীবাশ্ম এলাকা। গবেষক তার স্ট্র্যাটিগ্রাফি এবং তারিখ নির্ধারণের দক্ষতা প্রয়োগ করে ১৫ লাখ মিলিয়ন বছর পুরোনো জীবাশ্মগুলোর ভূতাত্ত্বিক প্রাচীনতা প্রমাণ করেছেন। তিনি পদচিহ্নগুলোর অবস্থান বিশ্লেষণ করেছেন। এর মাধ্যমে জানা যায় যে, পদচিহ্নগুলো কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তৈরি হয়েছিল এবং এগুলো সেখানকার নরম মাটিতেই তৈরি হয়েছিল।
ফেইবল বলেন, ‘যদি হোমিনিনগুলো একে অপরের পথ অতিক্রম না করেও থাকে, তবুও তারা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে একে অপরের পাশ দিয়ে হ্রদ তীরবর্তী অঞ্চলে চলাচল করেছিল।’
এই গবেষণার প্রধান লেখক ও পিটার্সবার্গে চ্যাথাম ইউনিভার্সিটির জীববিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কেভিন হাটালা বলেন, কঙ্কালের জীবাশ্মগুলো দীর্ঘদিন ধরে মানব বিবর্তনের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন পদচিহ্নের জীবাশ্ম থেকে পাওয়া নতুন তথ্য মানুষের শরীর এবং চলাফেরার বিবর্তন সম্পর্কে চমকপ্রদ বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরছে। এটি প্রাচীন মানব আচরণ এবং পরিবেশ সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ সূত্র তুলে ধরেছে।
পদচিহ্ন বিশ্লেষণের একজন বিশেষজ্ঞ হলেন কেভিন হাটালা। পদচিহ্নের জীবাশ্মগুলো তিনি বিশ্লেষণ করেন দেখেন যে, এগুলো জীবদেহের গঠনসংক্রান্ত বিজ্ঞান এবং চলাফেরার বিভিন্ন ধরন প্রতিফলিত করেছে। তিনি এবং তার কয়েকজন সহলেখক ৩ডি বিশ্লেষণ ব্যবহার করে এক সেট পদচিহ্ন অন্য সেট থেকে আলাদা করেছেন।
ফেইবল এই আবিষ্কারকে ‘এক ধরনের সৌভাগ্যজনক ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ২০২১ সালে জীবাশ্মবিদ লুইস লীকি নাতনি ও রিচার্ড লীকির মেয়ে লুইস লীকি একটি দল নিয়ে ওই স্থানটি পরিদর্শন করার সময় জীবাশ্মটি আবিষ্কার করেন।
এই দলে নেতৃত্ব দেন সিপ্রিয়ান নাইটে। তিনি স্থানীয় ছিলেন। এই দলটি অত্যন্ত প্রশিক্ষিত কেনিয়ার ব্যক্তিরা ছিলেন। তারা সাধারণত ভারী বৃষ্টির পর ভূমি পরিদর্শন করে।
তারা মাটির পৃষ্ঠে একটি জীবাশ্ম দেখতে পেয়ে, তার উৎস খুঁজে বের করার জন্য খনন করছিল। একটি স্তরের শীর্ষ অংশ পরিষ্কার করার সময় কিছু বড় পাখির পদচিহ্ন লক্ষ্য করেন খননকারী রিচার্ড লোকি। এরপরই প্রথম হোমিনিন পদচিহ্নটি দেখতে পান তিনি। এরপর লুইস লীকি একটি দল গঠন করেন যা ২০২২ সালের জুলাই মাসে পদচিহ্নের পৃষ্ঠটি খনন করে।
ফেইবল বলেন, এই মানব প্রজাতিগুলো একসঙ্গে বসবাস করেছিল বলে অনেক দিন ধরেই ধারণা করা হচ্ছিল। জীবাশ্ম রেকর্ড অনুযায়ী, মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ হোমো ইরেকটাস ১০ লাখ বছর আগেও টিকে ছিল। তবে পারানথ্রোপাস বইসেই পরবর্তী কয়েক লাখ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এটি কেন এমনটি ঘটেছিল তা বিজ্ঞানীরা জানেন না।
উভয় প্রজাতিই সোজা ভঙ্গিতে দুপেয়ে উচ্চ গতিতে চলাফেরা করত। তবে কীভাবে এই সহাবস্থানকারী প্রজাতিগুলো সাংস্কৃতিক এবং প্রজনন গতভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। সে সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি।
ফেইবল বলেছেন, পদচিহ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ এগুলো ‘ট্রেস ফসিল’ হিসেবে বিবেচিত হয়। ট্রেস ফসিল হলো এমন ধরনের জীবাশ্ম, যা সরাসরি কোনো জীবের শারীরিক অংশ নয়, কিন্তু এটি সেই জীবের আচরণের প্রমাণ দেয়। যেমন, পদচিহ্ন, বাসা বা গর্ত—এই সব কিছুই ট্রেস ফসিল হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এগুলো সেই জীবের চলাফেরা বা জীবনযাত্রার সাক্ষ্য দেয়।
অন্যদিকে শরীরের ফসিল (যেমন হাড় বা দাঁত) অতীত জীবনের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু পরিবেশের প্রভাব, যেমন পানি বা শিকারি প্রাণীর মাধ্যমে স্থানচ্যুত হতে পারে শরীরের ফসিল। তাই এগুলো সঠিকভাবে প্রমাণ সরবরাহ করতে পারে না। কিন্তু ট্রেস ফসিলগুলো স্থানচ্যুত হতে পারে না, তাই এগুলো সেই জীবের আচরণ সম্পর্কে আরও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দেয়।
তথ্যসূত্র: নিউজ মেডিকেল লাইফ সায়েন্স
আপনার মতামত লিখুন :