ঢাকা বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন: যেভাবে প্রভাব ফেলছে

হাসান মাহমুদ, ঢাকা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৫, ০৭:২১ পিএম

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন: যেভাবে প্রভাব ফেলছে

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিয়মিত ঘটনা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা নামে পরিচিত।

জলবায়ু বলতে আমরা কোনো এলকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়াকে বুঝি। বিজ্ঞানের ভাষায় একে গ্রিনহাউস প্রভাবও বলা হয়ে থাকে।

শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিশেষ করে মানুষের ভোগ-বিলাশের চাহিদা বৃদ্ধি পওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিল্পযুগের আগে পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা যা ছিল, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সেই তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে।

যা বলছেন বিজ্ঞানীরা

সুইডিশ বিজ্ঞানী আর্হেনিয়াস ১৮৯৬ সালে এ বিষয়ে প্রথম বর্ণনা দেন। তাঁর মতে, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বনের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। সূর্য থেকে আগত তাপ ও পৃথিবী থেকে বিক্ষিপ্ত তাপ কার্বন শোষণ করে নেয়।

এতে করে পৃথিবীর মোট তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৯৮৮ সালে ধারণাটি প্রথম স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। পৃথিবীর ৬০টির বেশি দেশের ২ হাজার ৫০০ বিজ্ঞানী এ বিষয়ে একমত যে, মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসই পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধির কারণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ

বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান তথা নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, আর্গন ও জলীয়বাষ্প বিদ্যমান। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে যোগ হওয়া বিভিন্ন গ্যাসের কারণে এ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যানবাহন, রান্না-বান্না, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কলকারখানায় ব্যাপকহারে জীবাশ্ম জ্বালানি তথা কয়লা, পিট, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। বিগত ২০০ বছর ধরে পশ্চিমা দেশগুলোতে অধিকমাত্রায় জ্বালানি ব্যবহারের কারণে এবং বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বে শিল্পায়ন যত হচ্ছে তত বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বায়ুমন্ডলে যুক্ত হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিগত ২০০ বছরে ব্যাপকহারে বন উজাড় এবং জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেল ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস অন্তত তিন গুণ বেড়েছে। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশের বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস জ্বালানি তেল উৎপাদন ও ব্যবহারের ফলে তৈরি হয়।

যদিও শব্দগুলো বিজ্ঞান বা পরিবেশ বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট। তবে শুধুমাত্র বিজ্ঞানীরাই নয় বরং অর্থনীতিবিদ, রাজনিতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন কয়েকটি নিয়ামকের ওপর নির্ভর করে। যেমন- ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, জৈব প্রক্রিয়া এবং পৃথিবী কর্তৃক সৌর বিকিরণের পরিবর্তন প্রভৃতি।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে নানা রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমন- ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, সাইক্লোন, খরা, জলোচ্ছ্বাস, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, দাবানল প্রভৃতি। এর ফলে মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যা বলছে

জলবায়ুর পরিবর্তন-সংক্রান্ত আন্তঃসরকার কমিটি বা আইপিসিসির এক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন যে চরম তাপপ্রবাহ, প্রচণ্ড ভারী বৃষ্টি, খরা বা সাইক্লোন ও দাবানল হতে দেখা যাচ্ছে, তাতে জলবায়ুর এই পরিবর্তন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (W-M-O) এবং নাসা (NASA) সহ ছয়টি জলবায়ু সংস্থা তাদের ২০২৪ সালের তাপমাত্রার তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে গেল ২০২৪ সালটি সকল বৈশ্বিক রেকর্ড ভেঙেছে এবং প্রথমবারের মতো প্রাক-শিল্প সময়ের চেয়ে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে।

সবথেকে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চল

বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির সবচেয়ে বেশি হয়েছে এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে। এসব দেশে ২০২৩ সালে মানুষ হতাহত ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বেশিরভাগই হয়েছে বন্যা ও ঝড়ের কারণে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলছে, একই সময়ে তাপদাহ বৃদ্ধির প্রভাবেও নাকাল ছিল এসব দেশের মানুষ।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) দ্য স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট ইন এশিয়া ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী গড় উষ্ণতার চেয়ে দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে এশিয়ার দেশগুলোর আবহাওয়া। ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সালের গড় তাপমাত্রার চেয়ে শুধু ২০২৩ সালেই এই মহাদেশে উষ্ণতা বেড়েছে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

জাতিসংঘের সংস্থার এই রিপোর্ট প্রকাশের সময়ও এশিয়ার দেশগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়া দেখা যায়। বাংলাদেশ, ভারতসহ কোনো কোনো দেশ তাপদাহে বিপর্যস্ত। আবার চীন-পাকিস্তানসহ কোনোটিতে চরম বৃষ্টির সঙ্গে বন্যা দেখা দিয়েছে।

ডব্লিউএমও প্রধান সেলেস্তে সাওলো বিবৃতিতে বলেন, খরা, তাপপ্রবাহ থেকে বন্যা ও ঝড় পর্যন্ত চরম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াসহ ২০২৩ সালে এশিয়ার অনেক দেশ রেকর্ড উষ্ণতম বছর অনুভব করেছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এই ধরনের ঘটনার ফ্রিকোয়েন্সি ও তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছে।

সংস্থাটি বলেছে, গত বছর এশিয়ায় পানি সম্পর্কিত আবহাওয়াগত ঝুঁকির সঙ্গে ৭৯টি বিপর্যয়ের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই বন্যা ও ঝড়। এতে মৃত্যু হয়েছে দুই হাজারের বেশি মানুষের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৯০ লাখ মানুষ। বন্যা ছিল মৃত্যুর প্রধান কারণ।

প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এশিয়ার উচ্চ পর্বত অঞ্চলের বেশির ভাগ হিমবাহ রেকর্ড ভঙ্গ করা উচ্চ তাপমাত্রা এবং শুষ্ক অবস্থার কারণে উল্লেখযোগ্য ভর হারিয়েছে। ২০২৩ সালে হিমালয় এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালায় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে কম ছিল।

দক্ষিণ-পশ্চিম চীন খরায় ভুগেছে। বিশেষ করে পশ্চিম সাইবেরিয়া থেকে মধ্য এশিয়া এবং পূর্ব চীন থেকে জাপান পর্যন্ত উচ্চ গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ প্রথম ১০টি দেশ

২০১৯ সালে জার্মানওয়াচ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রকাশিত ‍‍`বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে‍‍` শীর্ষে রয়েছে ক্যারিবীয় দ্বীপ দেশ পুয়ের্তো রিকো। এর পরই রয়েছে- মিয়ানমার, হাইতি, ফিলিপিন্স, পাকিস্তান এবং ভিয়েতনামের অবস্থান। এদর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। শীর্ষ দশে বাংলাদেশের পরই রয়েছে থাইল্যান্ড, নেপাল এবং ডমিনিকা। তবে, শুধু ২০১৮ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাপান।

সংগঠনটি জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর বিরূপ প্রভাব ধনী-গরীব সব দেশের ওপরই পড়েছে। এ কারণে ১৯৯৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নিয়ে এই সূচকটি তৈরি করা হয়।

জার্মান ওয়াচ নামের একটি সংস্থার গ্লোবাল ক্লাইমেট ইনডেক্স ২০২০-এ ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে জাপান, জার্মানি, ক্যানাডার নাম৷

১. জাপান

২০১৮ সালে জাপান তিনবার বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়েছে৷ জুলাইতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত দেশটিতে ২০০ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ ক্ষতি হয় ৭০০ কোটি ডলার৷ জুলাই থেকে আগস্টে তাপদাহে আক্রান্ত হয়ে ৭০ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়৷ সেপ্টেম্বরের সাইক্লোনে ক্ষতি ছাড়িয়ে গেছে ১২০০ কোটি ডলার৷ সব মিলিয়ে গত বছর সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে ১২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে৷

২. ফিলিপাইন্স

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফিলিপাইন্সের উত্তরাঞ্চলে হানা দেয় ভয়াবহ টাইফুন মাংখুট৷ ২৭০ কিলোমিটার গতিতে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টিতে বিপদে পড়েন আড়াই লাখ মানুষ৷ প্রাণ হারিয়েছেন ৫৯ জন৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পুরো বছরে মারা গেছেন ৪৫৫ জন৷

৩. জার্মানি

গত বছর ভয়বাহ তাপদাহে জার্মানিতে তাপমাত্রা তার যাবতীয় রেকর্ড ভেঙ্গেছে৷ এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক গড়ের চেয়ে দুই দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল৷ তাপদাহে মৃত্যু হয়েছে ১২৩৪ জনের৷ বৃষ্টির অভাবে ৭০ ভাগ জমি খরায় আক্রান্ত হয়েছে৷ এ কারণে ৩৫৪ কোটি ডলারের কৃষি ফসলের ক্ষতি হয়েছে৷ বছর জুড়ে আবহাওয়াজনিত কারণে দেশটিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২৪৬ জন৷

৪. মাদাগাস্কার

গত বছর পরপর দু’টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে আফ্রিকার মাদাগাস্কারে৷ সাইক্লোন আভা কেড়ে নেয় ৫১ জনের প্রাণ৷ পরবর্তীতে ইলিয়াকিমে মারা যান আরো ১৭ জন৷ সেই সঙ্গে বহু মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন৷

৫. ভারত

বন্যার কারণে সৃষ্ট ভূমিধ্বসে গত বছর ভারতের কেরালায় ৩২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ দুই লাখ ২০ হাজার মানুষ ঘরবাড়িছাড়া হয়েছেন৷ ২০ হাজার বাড়ি, ৮০ টি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ মোট ক্ষতি হয়েছে ২৮০ কোটি ডলারের৷ অক্টোবর আর নভেম্বরে পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানে সাইক্লোন তিতলি এবং গাজা৷ সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দেশটিতে দুই হাজার ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে ২০১৮ সালে৷

৬. শ্রীলঙ্কা

জলবায়ু পরিবর্তনে ২০১৮ সালে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা৷ মে মাসে ভয়াবহ বৃষ্টিপাতে ২০ টি জেলা আক্রান্ত হয়৷ এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত, ছয় হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে৷ বছরজুড়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮ জন৷

৭. কেনিয়া

২০১৮ সালের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে দুইগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে কেনিয়াতে৷ নদীর পানির উচ্চতার কারণে ৪৭ টি কাউন্টির ৪০ টিতেই মানুষ বিপদে পড়েন৷ ১৮৩ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত হন তিন লাখ ২১ হাজার ৬৩০ জন৷

৮. রুয়ান্ডা

ভূমিধসে দেশটিতে গত বছর ২৫ হাজার মানুষ আর পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ বন্যা পরবর্তী সময়ে কলেরা আর মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ে সেখানে৷

৯. কানাডা

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় নয় নম্বরে আছে ক্যানাডা৷ ২০১৮ সালের শুরুতে ১০০ বছরের মধ্যে সেখানকার পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা নেমে এসেছিল সর্বনিম্ন মাইনাস ৪৫ থেকে মাইনাস ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে৷ মে মাসে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার বন্যায় চার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন৷ দাবানলে ১৬ হাজার মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছে৷ জুলাইতে তাপদাহে কিউবেকে ৯৩ জন মারা গেছেন৷ সব মিলিয়ে বছর জুড়ে ১০৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন৷

১০. ফিজি

২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিনটি সাইক্লোনের কারণে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ফিজি-তে ৮ জন মারা গেছেন, বাড়িঘর হারিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ৷

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

মিয়ানমারে ২০০৮ সালের ‘ঘূর্ণিঝড় নার্গিস‍‍`-এর কারণে যে পরিমাণ মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে, তা গত দুই দশকের অন্যান্য ঘটনার চেয়ে ৯৫ ভাগ বেশি৷ একইভাবে হন্ডুরাসে, ১৯৯৮ সালের ‘হ্যারিকেন মিচ‍‍`-এর কারণে ৮০ ভাগের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়৷ ২০০৭ সালে বাংলাদের খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। রেডক্রসে হিসেবে ১০ হাজার মারা যায়। আর কোটি কোটি ডলারের সম্পাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়।

এদিকে এশিয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ১০তম অবস্থানে থাকা থাইল্যাণ্ডে ২০১১ সালের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়৷ ২০১২ সালের ‘হ্যারিকেন প্যাট্রিসিয়া‍‍`র ক্ষয়ক্ষতি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে৷ এই সময়ে সাইক্লোনের ঘটনা ঘটেছে ২৭টি৷ ফলে আবারও বলা দরকার যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেশি ঝুঁকিতে আছে স্বল্পোন্নত ও ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো৷

বাংলাদেশের সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬০-২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩টি বড় সাইক্লোনের ঘটনা ঘটেছে। এসব সাইক্লোনে ব্যাপক জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলির মধ্যে অন্যতম হলো দাবদাহ, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও উপকূলীয় এলাকায় বন্যা, যা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ বিভিন্ন দেশের সরকারের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির ২০১৪ সালের মূল্যায়নে এই বিষয়গুলো উঠে আসে৷ ইউরোপ, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বড় অংশে দাবদাহ ক্রমাগত বাড়ছে৷ একইভাবে, উত্তর অ্যামেরিকা ও ইউরোপে ভারী বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেড়েছে এবং কিছু দিন পরপরই বিশ্বের নানা জায়গায় একই উদাহরণ সৃষ্টি হচ্ছে৷

বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের মতো ধনী দেশগুলোর এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়তো তাদের খুব একটা গায়ে লাগবে না৷ কিন্তু দরিদ্র কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই ক্ষতির কথা একবার ভেবে দেখুন! এই টাকা তাদের বার্ষিক জিডিপির একটি বড় অংশ৷ কাজেই তাদের অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব পড়বে! আর ঘুরেফিরে সেই দেশের মানুষের ওপরই তো গিয়ে পড়ে সব ভোগান্তি৷

বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে বদলে যাবে আমাদের জীবন-যাপন। পানির সঙ্কট তৈরি হবে। খাদ্য উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে। কোনো কোনো অঞ্চল বিপজ্জনক মাত্রায় গরম হয়ে পড়বে, এবং সেই সাথে সমুদ্রের পানি বেড়ে বহু এলাকা প্লাবিত হবে। ফলে সে সব জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া

অতিরিক্ত গরমের পাশাপাশি ভারি বৃষ্টি এবং ঝড়ের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। ফলে জীবন এবং জীবিকা হুমকিতে পড়বে। গরীব দেশগুলোতে এসব বিপদ মোকাবেলার সক্ষমতা কম বলে তাদের ওপর এই চরম আবহাওয়ার ধাক্কা পড়বে সবচেয়ে বেশি।

পরিবেশ

তাপমাত্রা বাড়ায় উত্তর মেরুর জমাট বাধা বরফ এবং হিমবাহগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। ফলে সাগরের উচ্চতা বেড়ে উপকুলের নিচু এলাকাগুলো ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

এছাড়া সাইবেরিয়ার মত অঞ্চলে মাটিতে জমে থাকা বরফ গলতে থাকায় বরফের নিচে আটকে থাকা মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে, মিথেনের মত আরেকটি গ্রিনহাউজ গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। পৃথিবীর উষ্ণতা তাতে আরো বাড়বে, এবং বন-জঙ্গলে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়বে।

প্রকৃতি

প্রকৃতির চিরচেনা বসতির আবহাওয়া বদলের জেরে অনেক প্রাণী নতুন জায়গায় চলে যাবে বা যাওয়ার চেষ্টা করবে।

কিন্তু জলবায়ুর এই পরিবর্তন এত দ্রুত হারে এখন ঘটছে যে অনেক প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেমন, বরফ গলতে থাকায় পোলার বিয়ার বা উত্তর মেরুর শ্বেত ভালুকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

পাশাপাশি, আটলান্টিক মহাসাগরের স্যামন মাছ বিপন্ন হবে, কারণ যেসব নদীতে ঢুকে তারা ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্ম দেয়, সেগুলোর পানি গরম হয়ে যাচ্ছে।

ট্রপিক্যাল অঞ্চলের কোরাল রিফ বা প্রবাল-প্রাচীর উধাও হয়ে যেতে পারে, কারণ বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড সাগরের পানিতে মিশে পানির অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যেসব প্রভাব পড়ছে বলে আমরা উল্লেখ করেছি, এর সবগুলো ঘটতে শুরু করেছে বাংলাদেশেও৷ আশংকার কথা হলো, দিন দিন বাড়ছে এগুলো৷

বছরের প্রায় দশ মাস গরম থাকা, শুধু গরম বললে ভুল হবে৷ তীব্র গরম৷ বছরে কোনো রকমে দুই মাস তাপমাত্রা একটু কম থাকে, যার মধ্যে এক মাসকে আমরা এখন শীতকাল বলে ধরে নিই৷ সেটি সাধারণত নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়৷ এক মাস পর শীত আসবে, অথচ তখনও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে৷ বছরের মাঝখানে কারণে-অকারনে শুরু হয় অতিবৃষ্টি, যার ফলাফল হলো বন্যা৷ এ বছর যেমন শরৎকালেও ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে৷

এসব ঘটনাকে গবেষকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন৷ এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমছে, বাড়ছে নিত্য নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অসুখ-বিসুখ৷ সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা৷ ফলাফল হিসেবে শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে৷

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি

জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের চতুর্থ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানিয়েছে যে, এই শতাব্দীর মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে৷  দেশের ১৯টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ওই ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি আছে৷ এ কারণে ঘর হারাবে প্রায় দুই কোটি মানুষ৷

পার্বত্য এলাকায় অতিবৃষ্টি

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব মতে, চলতি বছরের অক্টোবরে চট্টগ্রাম বিভাগে এরইমধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭০ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে৷ মাসের প্রথম সপ্তাহে কক্সবাজার, টেকনাফসহ এই বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দুইগুণ বেশি বৃষ্টি হয়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপমাত্রায় পাহাড় এলাকার মাটির বুনন হালকা হয়ে যায়, আবার পরে অতি বৃষ্টির কারণে মাটি নরম হয়ে পাহাড় ধসের মতো ঘটনা এসব এলাকায় বাড়ছে৷ অবশ্য অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটাও এমন ধসের অন্যতম কারণ৷

বজ্রপাত

চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে ১৭০ জন৷ আর গত সাত বছরে মারা গেছে ১ হাজার ৭৬০ জন৷ গবেষকরা বলছেন, কোনো জায়গায় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের পরিমাণ ১২ শতাংশ বেড়ে যায়৷ সেখানে গত ৩০ বছরে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ১ ডিগ্রি৷ ফলে বেড়ে গেছে বজ্রপাতও৷

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

চলতি বছর পরপর তিনটি বন্যায় দেশের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়৷ বিশেষ করে উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ার সময় দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে৷ ব্যাপক ক্ষতি হয় ফসলের, যার খেসারত দিতে হয় বা হবে সব মানুষকেই৷

এছাড়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে বেশি বেশি ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে৷ স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চার-পাঁচটি বড় বড় ঘূর্ণিঝড় হয়৷ এছাড়া গত এক দশকে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, রোয়ানু ও মোরা৷ এ ধরনের আঘাতের সংখ্যা যে বাড়বে তা বলা চলে নির্দধায়৷

আমাদের করনীয়

গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। যতগুলো গাছ কাটা হবে তার থেকে দ্বিগুন পরিমাণ গাছ আমাদের রোপণ করতে হবে।

গাড়ি ও বিমানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাইকেল বা জনপরিবহনের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া কমিয়ে দিতে হবে।

বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে বায়ুর তাপমাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। কেননা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের মতো ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গত হয়, যা বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

আরবি/এইচএম

Link copied!