সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

গৌরব, ত্যাগ ও উন্নয়নের প্রদীপ্ত নাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

হাসানাত লোকমান

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৫, ০৯:৫২ পিএম

গৌরব, ত্যাগ ও উন্নয়নের প্রদীপ্ত নাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী- একটি গৌরবময় প্রতিষ্ঠান, যা স্বাধীনতার চেতনার ধারক ও বাহক। দেশের প্রয়োজনে এই বাহিনীর আত্মনিবেদন, ত্যাগ ও নিরবচ্ছিন্ন সেবার কথা বললে এক মহাকাব্য রচিত হয়। স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়ন, দুর্যোগ মোকাবিলা, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে জন্ম
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস শুরু হয় এক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের বীর যোদ্ধারা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুজিবনগর সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনী একযোগে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। সেনাবাহিনীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আজকের প্রজন্মের কাছে এক মহান শিক্ষার বাতিঘর।

পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের যাত্রা
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছিল এক পুনর্গঠনের অধ্যায়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য সেনাবাহিনী কেবল সামরিক দায়িত্বেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং জাতীয় পুনর্গঠনে অবদান রেখেছে। পরবর্তী সময়ে আধুনিকায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই বাহিনী আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিরক্ষা শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তি, উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সংযোজন, প্রশিক্ষণ উন্নয়ন, এবং কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুসংগঠিত ও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে বিবেচিত।

মানবিক সহায়তায় 
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস, ভূমিকম্প ইত্যাদি দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনন্য। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের দুর্যোগগুলোতে সেনাবাহিনী ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা, উদ্ধার অভিযান এবং অবকাঠামো পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

সাম্প্রতিককালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, সচেতনতা বৃদ্ধি, লকডাউন বাস্তবায়ন এবং খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।

জাতীয় উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ 
সেনাবাহিনী শুধু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ নয়, এটি দেশের উন্নয়নেরও অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশের সেতু, সড়ক, রেললাইন, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ সরাসরি যুক্ত থেকে দেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর মানবিক ভূমিকা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

বৈশ্বিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের গর্ব
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু দেশের মধ্যেই নয়, বিশ্ব শান্তিরক্ষায়ও অনন্য অবদান রাখছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনারা অসামান্য দক্ষতা, সাহস ও মানবিকতা প্রদর্শন করে আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়েছে। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান আমাদের দেশকে গর্বিত করেছে।

সন্ত্রাস দমন ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় অগ্রণী ভূমিকা
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিবাদ দমন, চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ এবং বিশেষ অভিযান পরিচালনায় সেনাবাহিনীর গোপন ও সরাসরি ভূমিকা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

২০২৪-এর গণ-আন্দোলনে প্রশংসনীয় ভূমিকা
২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনে যখন দেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষতা, সংযম ও দায়িত্বশীলতার এক অনন্য নজির স্থাপন করে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সেই সংকটময় মুহূর্তে তারা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু কখনোই জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি।

নৈরাজ্য ও সংঘাত এড়াতে সেনাবাহিনী অত্যন্ত কৌশলী ও মানবিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। তারা দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করেছে, যাতে জনগণের জানমালের ক্ষতি না হয়। কোথাও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, তারা দ্রুত হস্তক্ষেপ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে, অথচ কোথাও বাড়াবাড়ি করেনি বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ভয়ভীতি সৃষ্টি করেনি।

সেনাবাহিনীর এই দায়িত্বশীল অবস্থান জনগণের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তার পরিবেশ তৈরি করে। সাধারণ নাগরিকদের মাঝে আতঙ্ক দূর করে তারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, যাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত না হয়।

এই ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে যে, তারা শুধু একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী নয়; বরং জাতীয় সংহতি, শান্তি ও গণতন্ত্র রক্ষার এক নির্ভরযোগ্য শক্তি। তাদের পেশাদারিত্ব, ধৈর্য ও মানবিক মনোভাব দেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হয়ে থাকবে।

প্রযুক্তি ও আধুনিক যুদ্ধ কৌশলের প্রয়োগ
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সাইবার সিকিউরিটি, ড্রোন প্রযুক্তি, উন্নত অস্ত্র ব্যবস্থা, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ আই) ব্যবহারের দিকে সেনাবাহিনী অগ্রসর হচ্ছে।

নতুন প্রজন্মের প্রেরণা
সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সাহসিকতা নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল একটি সামরিক বাহিনী নয়, এটি জাতীয় গৌরব, আত্মত্যাগ ও উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সবসময় নিবেদিতপ্রাণ, যা আমাদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সামরিক শক্তি ও মানবিক দায়িত্ববোধের এই অপূর্ব সমন্বয় আমাদের সেনাবাহিনীকে বিশ্বের বুকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীÑ দেশের প্রয়োজনে এক অক্লান্ত প্রহরী, নির্ভরতার প্রতীক, গর্বের ধ্রুবতারা!

লেখক: প্রাবন্ধিক, অতিরিক্ত সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!