রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


হাসানাত লোকমান

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২৫, ১১:৫৪ এএম

ফ্যাসিস্ট কাঠামোর উৎস অনুসন্ধান: রুলস অব বিজনেস ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ

হাসানাত লোকমান

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২৫, ১১:৫৪ এএম

ফ্যাসিস্ট কাঠামোর উৎস অনুসন্ধান: রুলস অব বিজনেস ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ

ছবি : সংগৃহীত।

রাষ্ট্র কেবল একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় না, বরং তার ভেতরের নীতিনির্ধারক কাঠামো ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্য দিয়েই বাস্তবে জনগণের ওপর তার প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্রের যাত্রাপথে যে এক ধরনের ‘গোপন অথচ শক্তিশালী’ বাধা কাজ করছে, তা হলো রুলস অব বিজনেস ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ।

এই দুই উপাদান—যে উদ্দেশ্যেই গৃহীত হোক না কেন—আজ একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি অঘোষিত ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে।

রুলস অব বিজনেস: আমলাতন্ত্রের ‘নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা’

‘Rules of Business’ বা ‘সরকারি কার্যবিধি’ হলো রাষ্ট্রীয় কাজের নির্দেশনা পুস্তিকা। এটিতে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে কোন দপ্তর কী দায়িত্ব পালন করবে, কীভাবে নথিপত্র চলবে এবং কে কখন সিদ্ধান্ত নেবে। একদিকে এটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করলেও, অপরদিকে এটি একচ্ছত্র ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত, আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামরিক ও বেসামরিক সিদ্ধান্তে শেষ অনুমোদন প্রধানমন্ত্রীর হাতে হয়।

এই প্রক্রিয়া কেবল আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব ঘটায় না, বরং রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একজন ব্যক্তিকে প্রায় অলৌকিক ক্ষমতায় অভিষিক্ত করে। নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব তখন হয়ে ওঠে কেবল জনপ্রিয় নন, অতিমানবীয় ক্ষমতার অধিকারী।

নির্বাহী ক্ষমতার অবিশ্বাসজনক বিস্তার:

আমাদের প্রশাসনিক বাস্তবতায় দেখা যায়, একজন কর্মকর্তা কোথাও বদলি হোক, ছুটিতে যাক, বিদেশ সফরে যাক—সবকিছুর জন্য শেষ অনুমোদন লাগছে প্রধানমন্ত্রী বা তার নিকটতম অফিস থেকে। এমনকি একটি মন্ত্রণালয় তার বাজেট বরাদ্দ পেয়ে গেলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়।

এর ফলে প্রশাসন হয়ে পড়ে উচ্চস্তরের অনুমোদননির্ভর, যেখানে দায়িত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে না। অধঃস্তন দপ্তরগুলো হয়ে পড়ে মন্ত্রণালয়ের প্রতি নির্ভরশীল, একরকম জিম্মি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বারবার সরকারপ্রধান বদলেছে, কিন্তু রুলস অব বিজনেসের এই কাঠামো বদলায়নি।

এটাই প্রমাণ করে, ব্যক্তি নয়, কাঠামোই স্বৈরশাসনের জন্মদাতা।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ: সংসদের নিশ্বাসরুদ্ধ গণতন্ত্র

সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো—প্রতিটি সংসদ সদস্য তার বিবেক, মত এবং দলের বাইরে গিয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি কোনো সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তবে তার সদস্যপদ বাতিল হবে।

এর ফলে সংসদ সদস্যরা একরকম দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়েন। তারা আর জনগণের প্রতিনিধি নন, বরং হয়ে যান দলীয়প্রধানের ক্লোন। সংসদ রূপ নেয় এক ‘সম্মতির অডিটরিয়াম’-এ, যেখানে ভিন্নমতের কোনো স্থান নেই। ফলে বিতর্ক নয়, স্লোগানই হয় নীতিনির্ধারণের উপায়।

রুলস অব বিজনেস+অনুচ্ছেদ ৭০ = অব্যক্ত ফ্যাসিজম

যদি প্রশাসনের সব দপ্তর ও নীতিগত সিদ্ধান্ত একজন ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া চলতে না পারে, এবং যদি সংসদ সদস্যরাও সেই ব্যক্তির মতামত অনুসরণে বাধ্য হন—তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র আসলে একটি লোকতান্ত্রিক চেহারার ভেতরে একটি ফ্যাসিস্ট হৃদয় নিয়ে চলতে থাকে।

আমরা দেখি—যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, শাসনের ধরনে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। প্রতিবারই মন্ত্রিসভা, সংসদ, প্রশাসন এক ব্যক্তির চারপাশে আবর্তিত হয়। কারণ, কাঠামো তাই সাজানো হয়েছে।

গণতন্ত্রের বিপরীতে শুধু সেনা আইন নয়, এ ধরনের ‘আইনগত স্বৈরতন্ত্র’ও ততটাই বিপজ্জনক।

ইতিহাস আমাদের কী শেখায়?

১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, যারা রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে একটি ক্ষমতার কেল্লা গড়ে তুলেছিল। আমরা ভেবেছিলাম স্বাধীনতার পর সেই প্রাচীর ভেঙে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে—আমরা দুজন রাষ্ট্রপ্রধান হত্যার পরও, স্বৈরশাসকের পতনের পরও, বহুবার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এলেও আমরা কাঠামো বদলাইনি।

দেশে বহুবার সরকারপ্রধানের বদল হয়েছে কিন্তু রুলস অব বিজনেস ও ৭০ অনুচ্ছেদ অটুট থেকেছে। এটি প্রমাণ করে, আমরা ব্যক্তি পরিবর্তন করি, ব্যবস্থা নয়। ফলে শাসন বদলায়, শোষণ নয়।

সংস্কারের প্রস্তাব: গঠনমূলক উত্তরণ

১. রুলস অব বিজনেস পুনর্লিখন
প্রধানমন্ত্রীর হাতে সবকিছু কেন্দ্রীভূত না রেখে, প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দিতে হবে। এ জন্য সময়সীমা, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।

২. অনুচ্ছেদ ৭০ এর সংশোধন
সংসদ সদস্য যেন দলীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে বিবেকে বিভাসিত হয়ে মত প্রকাশ করতে পারেন—এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে দল পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর জন্য কঠিন শাস্তি থাকলেও, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে।

৩. রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক কাঠামো
প্রত্যেক রাজনৈতিক দলে অভ্যন্তরীণ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করতে হবে। উত্তরাধিকার বা আজীবন নেতৃত্বের ধারা গণতন্ত্রের বিপরীত।

৪. বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা
স্থানীয় সরকার, ইউপি থেকে জেলা প্রশাসন পর্যন্ত স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। এতে উপরমুখী নয়, জনগণমুখী প্রশাসন গড়ে উঠবে।

৫. এখনই সময় কাঠামো বদলের। 
বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। কিন্তু প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর দাসত্বে সেই সম্ভাবনা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই, তাহলে প্রথমে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রীয়করণ ভাঙতে হবে। কেবল নির্বাচন নয়, দরকার কাঠামোগত রূপান্তর।
ব্যক্তির পরিবর্তন নয়, প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।

দারুণ! নিচে আপনার প্রবন্ধের উপসংহার অংশকে নতুন রূপে, আরও সংবেদনশীল, দার্শনিক এবং আহ্বানভিত্তিক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করছি—এই অংশটির শিরোনাম রাখা হয়েছে ‘শেষ অনুধ্যান: কাঠামোর অতল থেকে আলো’। আপনি চাইলে শিরোনামটি পরিবর্তন করে নিতে পারেন নিচে দেওয়া বিকল্পগুলো থেকে।

শেষ অনুধ্যান : কাঠামোর অতল থেকে আলো

এখনই সময় দাঁড়াবার।  প্রশ্ন তোলার—রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি চাকা কেন একক ইচ্ছার ইন্ধনে ঘোরে? কেন আমলাতন্ত্রের পদোন্নতি, বদলি, এমনকি ছুটির অনুমতির মতো সাধারণ সিদ্ধান্তও প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করে? আর কেনইবা সংসদ সদস্যগণ নিজের বিবেক নয়, একক নেতৃত্বের সংকেত অনুযায়ী ভোট দেন—যেখানে গণতন্ত্রের চেতনায় তা সরাসরি সাংঘর্ষিক?

গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, এটি এক বিশ্বাসভিত্তিক কাঠামো—যেখানে বিকল্প মত, সমান অংশগ্রহণ ও ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। শাসন নয়, নেতৃত্ব চাই; ক্ষমতা নয়, জবাবদিহিতা চাই। কাঠামোগত কেন্দ্রিকতা ভেঙে না দিলে, একজন সৎ নেতাও এই ব্যবস্থায় একদিন একনায়ক হয়ে উঠবেন—কারণ কাঠামোই তাকে তেমন বানায়।

আমরা চাই এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে জনপ্রতিনিধি হবেন জনগণের কণ্ঠস্বর, আর আমলা হবেন স্বচ্ছ নীতির ধারক—দুইয়েরই স্বাধীন পরিসর থাকবে, জবাবদিহিতার সঙ্গে। কাঠামোর আধিপত্য শুধু ব্যর্থতা নয়, এটি এক ধরনের আত্মঘাতী নির্ভরতা, যা সার্ভিস ডেলিভারির গতি রুদ্ধ করে, মানুষকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে।

সুতরাং রুলস অব বিজনেস ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ—এই দুটি মূল ফাঁস যদি না সংস্কার হয়, ততদিন প্রকৃত গণতন্ত্রের আলো এক কাঠামোগত অন্ধকারেই আটকে থাকবে।

এই কাঠামো শুধরে না নিলে রাষ্ট্র একটি নিষ্প্রাণ কাঠের ঘোড়ায় পরিণত হবে—চালানো যাবে, কিন্তু প্রাণ থাকবে না। তাই পরিবর্তন এখন কেবল রাজনৈতিক প্রয়োজন নয়, এটি মানবিক ও নৈতিক দায়। নতুন প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়—একটি উত্তরোত্তর শক্তিশালী, ভারসাম্যপূর্ণ এবং মানবিক রাষ্ট্র রেখে যাওয়া।

রাষ্ট্র হোক জনগণের, এককেন্দ্রিক ক্ষমতার নয়।

মুখোশ নয়, গণতন্ত্র যেন শুদ্ধ জীবনচর্চা ও বিশ্বাসের ভঙ্গি হয়।

Link copied!