ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৪, ০৯:৩২ পিএম

চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

১৯৬৩ সালে ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয়। তখন একে ঢাকা ফিভার হিসেবে নামও দেওয়া হয়েছিল। ডেঙ্গুর প্রথম বড় আউটব্রেক হয় ২০০০ সালে। তখন বিজ্ঞানীরা একে ডেঙ্গু হিসেবে চিহ্নিত করে। ওই বছর বাংলাদেশ ৫৫৫১ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। ৯৩ জন মারা যায় ওই বছর। এরপর প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। তবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু এপিডেমিক আকার ধারণ করে। ওই বছর সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১০১৩৫৪ জন মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৭৯ জন মারা যায়।

বর্তমানে সারা দেশে আবারও ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, এ বছরেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৬৪ জন। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সাত হাজার ৭৬৭ জন। যা একটি গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করে। কিন্তু এ বছর রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে এখনো মশাবাহিত এ রোগ মোকাবিলায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি করপোরেশন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যতম সমস্যা মশা ও মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ম্যালেরিয়া এবং চিকুনগুনিয়া। মশাবাহিত এই রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর রূপে রয়েছে ডেঙ্গু। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় ডেঙ্গু এখন এন্ডেমিক (Endemic) বা স্থানীয় আকার ধারণ করেছে। করোনার সময় ডেঙ্গু কিছুটা নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে ছিল। তবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের সব ইতিহাস ভেঙে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সর্বোচ্চ রোগী ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মারা যায় ১৭০৫ জন। এ বছরও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থেমে নেই। এ পর্যন্ত ৯০০০ এরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে এবং ৭০ জন মারা গেছে। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর দিক থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এগিয়ে। মশাবাহিত রোগ নির্মূলের মূল উপায় হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণ। ডেঙ্গুর বাহক মশা হলো এডিস প্রজাতির। বাংলাদেশে দুই প্রজাতির এডিস মশা ডেঙ্গু ছড়ায়। তার মধ্যে এডিস ইজিপ্টটি ডেঙ্গুর জন্য ৯৫ ভাগ দায়ী। এডিস ইজিপ্টটিকে নগর বা শহরের মশা বলা হয়। অপরিকল্পিত নগরায়ণের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি মশা হলো এডিস অ্যালবোপিকটাস। একে এশিয়ান টাইগার মশাও বলা হয়। এটি গ্রামাঞ্চল বা যেসব এলাকায় গাছপালা অনেক সেই জায়গাগুলোয় বেশি জন্মায়। গাছের কোটরে এটির আদর্শ জন্মস্থান। এটি ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য মাত্র পাঁচ ভাগ বলেন বিজ্ঞানীরা। দুটি মশাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাত্রে জমা পানিতে জন্মায়। যেটি তার জন্মস্থানে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়। এই মশাগুলো কীটনাশকের প্রতিও সহনশীল। কীটনাশক প্রয়োগ করে সহজেই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে ডেঙ্গুর বাহক মশা নিয়ন্ত্রণে সেই কীটনাশকেরই ব্যবহার করতে হবে যেটি কার্যকরী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত অনেক কীটনাশক রয়েছে যেগুলো ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিরুদ্ধে কার্যকরী, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত।

জনগণের দাবির মুখে এরই মধ্যে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেলজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রবীণ ও অসীম সম্ভাবনাময়ী তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত এই সরকারের কাছে বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া অপরিসীম। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করছে, তরুণদের হাতে বদলে যাবে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ডেঙ্গু একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করে দেখিয়েছে। আর এই সমস্যাটির সমাধানও এই সরকারের মাধ্যমে হবে বলে বিশ্বাস। মশার নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো মশা নিয়ন্ত্রণে উপযোগী ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস তরুণদের হাতে বদলে যাবে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ডেঙ্গু একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করে দেখিয়েছে। আর এ সমস্যাটির সমাধানও এই সরকারের মাধ্যমে হবে বলে বিশ্বাস করি। মশা নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদদের কাজে লাগানো দরকার। বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে কীটতত্ত্ববিদদের পদ থাকলেও অজানা কারণে সেই পদগুলো ফাঁকা। ডেঙ্গু মৌসুম আসন্ন। তাই এখনই জোরেশোরে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ এখনই শুরু করতে পারলে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব।

চলতি আগস্ট মাসে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৮ জন। তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৫ জন ভর্তি হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোয়। এর বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগে ৫০, বরিশাল বিভাগে ৪২, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৯, ঢাকা মহানগরের বাইরে ১৬, খুলনা বিভাগে ৯, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬ ও রাজশাহী বিভাগের হাসপাতালে ১ জন ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮ হাজার ৯৩০ জন। এর মধ্যে চলতি মাসে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬১০ জন। এ সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। আর পুরুষ ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মধ্যে ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ ও নারী ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয় গত বছর। সে সময় ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।

ডেঙ্গু এমন কোনো জটিল রোগ নয় যে, মানুষের মৃত্যু হবে। সঠিক সময়ে প্রতিরোধ করা গেলে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডেঙ্গুর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। নতুন সরকারের অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের নেতৃত্বে মশা ও মশাবাহিত রোগমুক্ত বাংলাদেশ পাওয়ার প্রত্যাশা।

 

সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ

আরবি/জেডআর

Link copied!