ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

রাজনীতিবিমুখ কেন তারুণ্য

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৪, ১১:৩৮ এএম

রাজনীতিবিমুখ কেন তারুণ্য

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

তারুণ্য এবং পরিবর্তন-এই মুহূর্তে পৃথিবীর দুটি শক্তিশালী শব্দ। একে অপরের পরিপূরক। একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভালো-মন্দ মিলে। পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পরিবর্তনের হাওয়া আর তারুণ্য নেতৃত্ব দিচ্ছে সেই জাগরণের।

বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, পৃথিবীর মধ্যে তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ। তারপর চীনে আছে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্রে ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তরুণরাই সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বায়ান্ন থেকে একাত্তর, নব্বই এবং সর্বশেষ চব্বিশের অভ্যুত্থান-সবখানে তারুণ্যের হাত ধরেই এসেছে বিজয়। পাশাপাশি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও তারুণ্যের ভূমিকা অনন্য। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি থেকে শুরু করে ব্যবসাবাণিজ্য-সর্বত্রই তারুণ্যের জয়জয়কার। কিন্তু একটি বিষয়ে তারুণ্যের প্রবল অনাগ্রহ। তীব্র অনিচ্ছা। সেটি হলো, বাংলাদেশের রাজনীতি। দিনে দিনে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ‘আই হেইট পলিটিক্স’ টাইপের একটি প্রজন্মই তৈরি হয়ে গেছে এ মাটির বুকে যারা নিজের জ্ঞান,  প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের জন্য সবকিছু করতে রাজি শুধু রাজনীতি ছাড়া!

একটু দৃষ্টি বাড়ালে আমরা দেখি, বিশে^র অনেক যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে যুগে যুগে ভূমিকা পালন করছে তরুণরা। খোদ মার্কিন মুল্লুক থেকে শুরু করে ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি বাংলাদেশের সর্বশেষ অভ্যুত্থান-সবখানে তারুণ্য দেখিয়েছে তার স্পর্ধা। কিন্তু রাজনীতিতে তরুণদের অনাগ্রহ নানা ভাবনার জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে রাজনীতির গুনগত মান নিয়ে।

এক জরিপে দেখা গেছে, বিশে^ ১২০ কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে। অথচ এই তরুণদের মধ্যে জনপ্রতিনিধিত্বের হার ২ ভাগেরও কম। এটি মূলত রাজনীতির প্রতি তরুণদের অনাস্থার বহির্প্রকাশ। আমাদের দেশে ২৪ বছর বা তার নিচের বয়সের মানুষের পরিমাণ ৪৯ শতাংশ। আর কর্মক্ষম মানুষ আছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ। এই কর্মক্ষম মানুষের একটি প্রধান অংশ হলো তরুণ।

তরুণদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে অরুচি কেন? যে রাজনীতিই শেষ পর্যন্ত দেশের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়, সেই রাজনীতিতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যুক্ত তো হচ্ছেই না বরং এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে। আর এর প্রধান কারণ হিসেবে আইপিইউয়ের ফোরাম অব ইয়ং পার্লামেন্টারিয়ানসের প্রেসিডেন্ট অসুরো মাওরিনে জানান, রাজনীতিতে আদর্শহীনতা ও মিথ্যার ছড়াছড়ি। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিকরা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন, মিথ্যা কথা বলেন কিন্তু তরুণদের মেধার কোনো দাম দেন না। ১৮ বছর বয়সের একজন তরুণ অপরাধ করছে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে তাদের শাস্তি হয় কিন্তু তাদের নেতৃত্বে আনা হয় কতজনকে? মাওরিনের মতে, তরুণদের মধ্যে আবার নারীরা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে কারণ সারা বিশে^র পুরুষরা মনেই করে নারীরা ঘরের কাজ করবে আর তাই তাদের শিক্ষা দেওয়া হয় না, যার ফলে তারা পিছিয়ে পড়ে সব ক্ষেত্র থেকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি বিমুখতার সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি, আদর্শহীনতা। সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা ভুলে ক্ষমতা লোভ-লালসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে অতীতের গৌরবজনক অধ্যায়কে ভূ-লুণ্ঠিত করেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলো। ফলে তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার মতো কোনো আশাজাগানিয়া বর্তমান নেই তাদের। আছে উল্টো ছবি-রাজনীতিবিদ মানেই দুর্নীতিগ্রস্ত, রাজনীতি মানেই সংঘাত, রক্তপাত, হানাহানি, রাজনীতি মানেই ক্ষমতার আস্ফালন, দখল, জুলুম, নির্যাতন। মূলত, বাংলাদেশের রাজনীতি পথ হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই। ফলে আজকে যারা বয়সে তরুণ তাদের কাছে রাজনীতির কোনো ভালো উদাহরণ তৈরি হয়নি। যার ফলে আজকের মেধাবীরা জীবনে অনেক কিছু হতে চায়, শুধু রাজনীতিবিদ হতে চায় না। আব্রাহাম লিংকনের মতো শৈশবে কেউ আর বলে না, ‘বড় হয়ে আমি প্রেসিডেন্ট হতে চাই’।

অথচ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর প্রতি বিমুখিতার জন্য শুধু বাংলাদেশের রাজনীতির নেতিবাচক অভ্যাসগুলোই দায়ী নয়। আমার মনে হয় আমাদের পরিবার, শিক্ষা, সামাজিক এমনকি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ছেলে-মেয়েদের একধরনের আত্মকেন্দ্র্র্রিক হয়ে গড়ে তোলার চেষ্টায় লিপ্ত। আমি, আমি, আমিই, আমার ক্যারিয়ার, আমার জীবন, আমার সাফল্য- প্রতিনিয়ত ‘আমার আমার’ টাইপ মানসিকতা রপ্ত করছে আমাদের কিশোর-তরুণেরা। আমিত্বের বাইরে সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি একজন মানুষের যে বিপুল দায়ভার আছে সে শিক্ষা আমরা কতটুকু দিতে পারছি আমাদের সন্তানদের! বরং প্রযুক্তি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উলঙ্গপনার এ যুগে আমাদের সব আয়োজন সন্তানকে দ্রুত সেলিব্রেটি কিংবা ভাইরাল বানানোর তাড়নায় ন্যস্ত।

অন্যদিকে, দোষ আছে রাজনীবিদদেরও। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যা চলছে তাতে কোনো সুস্থ মানুষেরই আগ্রহ থাকার কথা নয়। সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ ভুলে গিয়ে, দেশপ্রেমের ফাও বুলি আওড়িয়ে রাজনীতিকে মেধাবী প্রজন্মের কাছে পরিণত করা হয়েছে প্রবল অচ্ছুত বস্তু হিসেবে। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতিকে বানানো হয়েছে ক্ষমতার সিঁড়ি। যে ক্যাম্পাস থেকে উঠে আসার কথা মেধাবী ছাত্র নেতৃত্ব সেখানে হয়েছে মূলত হল দখল, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস। ফলে স্বভাবতই রাজনীতি থেকে মুখ ফেরাতে বাধ্য হয়েছে তরুণ প্রজন্ম। দেশে নির্বাচন হয়েছে, ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে কিন্তু কোথাও তারুণ্যের অংশগ্রহণের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। কেউ ভাবেনি দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহৎ এ অংশটি নিয়ে। তারুণ্যের সম্ভাবনা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ফলে রাজনীতির দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার কোনো সুযোগও তৈরি হয়নি।

তরুণদের রাজনীতিবিমুখিতার পরিনামও ভালো হওয়ার কথা নয়। একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চিন্তা করলে সেখানে দেশপ্রেম, সাম্য, জবাবদিহি ইত্যাদি বিষয়গুলোর চর্চা অত্যন্ত জরুরি। তরুণ প্রজন্মের ভাবনা, দর্শন রাষ্ট্রকে দিতে পারে সৃজনশীল নির্দেশনা। বিশেষ করে, রাজনীতিচর্চা ব্যতীত তারুণ্যকে গ্রাস করে নানা ধরনের সংকট। সমাজে তৈরি হয় বন্ধ্যত্ব। তর্কের সুযোগ হারিয়ে যায়। গড়ে ওঠে প্রশ্নহীন, প্রতিবাদহীন প্রজন্ম। তখন জাতি, রাষ্ট্রও পথ হারিয়ে ফেলে। রাজনীতিবিহীন সমাজে নাগরিক অধিকারচর্চার সুযোগ লুপ্ত হয়; শৃঙ্খলাবিহীন হয়ে ওঠে সবকিছু। তারুণ্যের মেধা, মননশীলতা রাজনীতিকে দিতে পারে অনেক কিছু, যার ফল পেতে পারে সমাজ-রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক চর্চায় আশার কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না।

দেশে এখন নানা ধরনের সংস্কার চলছে। এ সুযোগে রাজনীতিকেও ঢেলে সাজাতে হবে। সময়-বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে। তারুণ্যকে জায়গা না দিলে রাজনীতির প্রচলিত ধারা যে খুব শিগগিরই মুখ থুবড়ে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। তাই ঘুণেধরা অচলায়তন ভেঙে তারুণ্যের স্বপ্ন, চিন্তার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে। ছাত্র-রাজনীতিকে ‘দলীয় পেটুয়াবাহিনীর’ অপবাদ থেকে বেরিয়ে এসে মেধাবীদের আগ্রহের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সংস্কার আয়োজন, যারা তারুণ্যের ভাবনাকে উপলব্ধি করে সময়োপযোগী একটি রাজনৈতিক ধারণা আমাদের উপহার দেবে। মোটকথা, প্রচলিত ধারণা থেকে বের হতে না পারলে রাজনীতিতে তারুণ্যের অনাগ্রহ থেকেই যাবে।

 

আরবি/জেআই

Link copied!