ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

শুভ বাংলাদেশের প্রত্যাশা

আবুল মোমেন

প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৪, ১২:৫০ পিএম

শুভ বাংলাদেশের প্রত্যাশা

আবুল মোমেন। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

হয়তো প্রশ্ন তোলা যায়, বাংলাদেশে আরও সংবাদপত্রের কি প্রয়োজন আছে? সংবাদপত্র কি যথেষ্ট নেই? সংখ্যার বিচারে অবশ্যই একটু বেশিই রয়েছে সংবাদপত্র। রাজধানী ঢাকা থেকে তো প্রচুর পত্রিকা প্রকাশিত হয়ই, এমনকি ছোট জেলা শহর থেকেও কম নেই সংবাদপত্র। সব মিলে কত যে পত্রিকা বেরোয় তার হিসাব হয়তো সরকারের কাছে আছে, পাঠকের কাছে ততটা নেই। কোন পত্রিকা কার কী উদ্দেশ্য সাধন করে তা বোঝা কঠিন।

সবাই জানি এ হলো প্রযুক্তির কাল। ফলে মুদ্রিত পত্রিকার কদর কমছে এখন। এ তো অনলাইনের যুগ। এই সময়ে আবার পত্রিকা?বিনিয়োগকারীর সাহসের প্রশংসা করতে হয়। তবু আশা করি তিনি ও তাঁর সাংবাদিক দল মিলে জাতিকে একটা চমক দিতে পারবে। রূপালী বাংলাদেশের কাছ থেকে আমরা সেই চমকের অপেক্ষায় থাকব।

আমাদের দেশে বহুকাল ধরে রাজনীতিই সংবাদপত্রের মুখ্য বিষয়। ঔপনিবেশিক আমলে সেটাই ছিল স্বাভাবিক, কারণ তখন মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দিনে দিনে গুরুত্ববহ ও জরুরি হয়ে উঠেছিল। 

পাকিস্তান আমলে দেশ স্বাধীন বলে বিবেচিত হলেও, নিয়মিত একটা স্বাধীনতা দিবস পালিত হলেও, কার্যত সেই চব্বিশ বছর ছিল আরেক ঔপনিবেশিক শাসন। তখনো ব্রিটিশের মতো একইভাবে চলেছে পাঞ্জাবিদের শাসন ও শোষণ। তখন সংগতভাবেই প্রশ্ন উঠেছিল পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন? তাই সংগত কারণে আবারও স্বাধীনতার সংগ্রাম চলেছে এবং সংবাদপত্রেও রাজনৈতিক ইস্যু মুখ্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলজুড়ে এই অঞ্চলের মানুষ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। মূলত তাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল বঞ্চনা ও শোষণ থেকে মুক্তি। রাজনৈতিক আন্দোলন গতিশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত শতকের ষাটের দশক থেকে সমাজের রাজনীতিকরণ আরও বেশি হয়েছে। তাতে তখনকার মতো স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রামে জাতিকে প্রস্তুত করা সহজ হয়েছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে দ্রুত মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ভয়ভীতি পেছনে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাতে এটি হয়ে উঠেছিল জনযুদ্ধ। জাতির এই রূপান্তরে নেতৃত্বের পাশাপাশি সংবাদপত্রও অনুঘটকের কাজ করেছে।

কিন্তু স্বাধীনতার পরেও আমরা পারিনি রাজনৈতিক চিন্তার বাইরে জীবনের আরও নানা দিকে সমাজের চিন্তা, মনন ও সৃজনশীলতাকে প্রসারিত করতে। এ সময়ে রাজনৈতিক বিবাদ-বিভাজন বরং বেড়েছে। ফলে সবসময়ই সমাজে একটা তপ্ত আবহ বিরাজ করেছে। এতে মানুষের মধ্যে এই বিভাজনের উত্তাপ কেবল ছড়িয়েছে। সংক্রামক রোগের মতো মনের উত্তাপ বাড়তে বাড়তে সমাজে বিবাদ-সংঘাতের পরিবেশ মহামারির মতো বিরাজ করেছে এবং তা মাঝে মাঝে বিস্ফোরিত হয়েছে। এটা এক রকমের অসুস্থতা এবং তাতে রাজনীতি মানবিক বিবেচনা যেমন হারিয়েছে তেমনি জাতীয়, বৈশ্বিক ও ভবিষ্যৎ চেতনারও ঘাটতি বেড়েছে। এরই ফল হলো দলের কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুঃশাসন এবং দুর্নীতি ও সহিংসতার প্রকোপ।

এর সঙ্গে যুক্ত হয় অসহিষ্ণুতা, অনুদারতা এবং বিদ্বেষ, হানাহানির মনোভাব। রাজনীতি এর স্রষ্টা, লালনকারী। এর ভেতরে ভিন্নমতের প্রকাশ ছিল সামান্য। প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হতে দেওয়া হয়নি। আদতে রাজনীতি হয়ে পড়েছিল ক্ষমতা বা বিত্তকেন্দ্রিক, এক জনতাবিমুখ দেশ-অচেতন ক্ষুদ্র দলীয় ভাবনাচিন্তার গণ্ডিতে বাঁধা। দেশে রাজনৈতিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে বিগত সরকারের পতনের পরে এখন আবারও একটা সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যাত্রাকে সুসংহত করার। যেমন গণমুখী সরকার দরকার তেমনি জাতীয় পরিসরে উদার গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ কাজে সংবাদপত্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। সেদিক থেকে নতুন একটি পত্রিকার প্রকাশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।

আজকের দিনে রাজনীতির প্রসঙ্গটি নতুনভাবে আসতে হবে। আমি বহুকাল ধরে লিখেছি, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতি নির্মাণ করতে পারেনি। জনযুদ্ধের পরিসরে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তার তাৎপর্য আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন, এমনকি অ্যাকাডেমিশিয়ানরাও ধরতে পারেননি। কারণ, ঐক্যবদ্ধ জাতির বিপুল ত্যাগ ও অসীম বীরত্বের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা তা যে সত্তরের নির্বাচনের পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ম্যান্ডেটকে ছাপিয়ে গিয়েছিল তা বঙ্গবন্ধুও উপলব্ধি করেননি। ফলে তিনি চেয়েছিলেন সেই তামাদি ম্যান্ডেট অনুযায়ী সংবিধান রচনা ও তার ভিত্তিতে দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্বে আইনত বৈধ সরকার গঠন করে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূত্রপাত করতে। কিন্তু তাতে দুর্লভ ও অতি মূল্যবান জাতীয় ঐক্যে চিড় ধরে গেল এবং দেশে বিভাজনের রাজনীতি শুরু হলো তখন থেকে। আর সেই থেকে আমরা বিভেদ ও বিভাজনের চর্চা করছি। প্রত্যেক সরকারই পাল্লা দিয়ে, ভিন্নমত প্রতিহত করতে কঠোর থেকে কঠোরতর পথ অবলম্বন করেছে। তারই সর্বশেষ প্রতিভূকে হটিয়ে ছাত্র-জনতা পুনরায় বিজয় এনেছে।

এবার আমরা অন্তর্ভুক্তি ও সর্বজনীনতার কথা শুনছি। এ সময়ে সংবাদপত্রের উচিত হবে নতুনভাবে সৃষ্ট সুযোগকে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাজে লাগানো। নতুনতর রাজনীতির বয়ান তৈরি, জীবনের নানা বৈচিত্র্যময় দিকের সন্ধান প্রদান এবং সমাজের নানা স্তরের শুভ উদ্যোগগুলোকে সামনে নিয়ে আসা সংবাদপত্রের কাজ। কেননা আমরা চাই মানুষ জীবনের গভীরতর মূল্য উপলব্ধি করুক। জীবনযাপনকে সুন্দর ও উপভোগ্য করে তুলুক। আর এভাবে নির্মিত হবে এক শুভ বাংলাদেশ এটাই আজ প্রত্যাশা।

কবি, প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়

আরবি/জেডআর

Link copied!