দেশে প্রায় ১৮ বছর ধরে বৈধ শাসক ছিল না। অপশাসনে অতিষ্ঠ হয়েছে আপামর জনসাধারণ। দীর্ঘ এই সময়ে আইনের শাসন যেমন ছিল না, তেমনি ভোটাধিকারও ছিল না। অতঃপর ছাত্র-জনতার সার্থক এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এর আগে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে ঠিকই তবে শাসকের অন্যায্য তৎপরতায় আগের সেই পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে প্রতিবেশী দেশের কলোনিতে পরিণত হয়ে যায়! বস্তুত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের জনগণ প্রথম গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বাদ পায়। এরপর বাংলাদেশের জনগণ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্তির স্বাদ পেল।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিখোঁজের ইতিহাস ধীরে ধীরে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে অপহৃত হয়ে যাওয়া গণতন্ত্র রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল। জনসাধারণের একান্ত কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র আবার ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায় স্বৈরাচারী এরশাদের নগ্ন হামলায়। বেগম খালেদা জিয়ার বিচক্ষণতা জাতিকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনে পুনরায়। তবে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত প্রকট হয়ে ওঠে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে ফখরুদ্দিন-মঈন গং-এর পাতানো খেলা থেকে। তারপর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকশনের নামে ভোটারবিহীন সিলেকশন, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতারণামূলক নিশি রাতের ভোট ডাকাতি হতবাক করেছিল বিশ্ব বিবেককে। আর জাতির জন্য অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দু:খজনকভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিকব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়। ‘আমরা আর মামুরা’ টাইপের এমন ডামি নির্বাচনের প্রহসনে খোদ ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিই আজ অভিধানের পাতা থেকে বিদায় নেওয়ার অবস্থা।
বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে শতকরা দুই ভাগের কম ভোটারের উপস্থিতি প্রমাণ করে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মুক্তিকামী জনগণেরই বিজয় হয়েছে। একই সঙ্গে ভোট বর্জনের ক্ষেত্রে নজির স্থাপনকারী বাংলাদেশের মুক্তিকামী ও গণতন্ত্রমনা মানুষও বিজয়ী হয়েছেন- ভোট ডাকাতদের ডামি নির্বাচনের খেলা থেকে নিজেদের দূরে রেখে।
আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পথচলা যখন বারংবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল ঠিক তখন রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্র পরিচালনায় তার দক্ষতা ও দূরদর্শিতার কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা থেকে মুক্ত করে স্বনির্ভর বাংলাদেশের পথে চালিত করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জোরেশোরে নানা প্রকার উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড শুরু করেন। ফলে বাংলাদেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে।
জনসাধারণের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্রের সুবাতাস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বিএনপি গঠন করেন। দলে ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব মতাদর্শের বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিকে একত্র করেছিলেন। তার এই মহান উদ্যোগের মধ্য দিয়েই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে আইনের শাসনও পুন:প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে স্বাধিকার আর গণতন্ত্রের লক্ষ্যে সর্বোতভাবে রক্তক্ষয়ী একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এই জাতি- অচিরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়ে বাকশালে আটকে যায় তার সব আশা-ভরসা। আর ‘৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ‘৭৭ এর নির্বাচন পর্যন্ত দেশে শাসনব্যবস্থারও কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বহুদলীয় গণতন্ত্রে পদার্পণ করে দেশ।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সমাদৃত। একজন সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সংকটে ত্রাণকর্তা হিসেবে তিনি বারবার দেশকে সংকটমুক্ত করেছেন, বাঁচিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন ও দিকনির্দেশনা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশের জনগণ তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিকে তিনবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে নিরলস চেষ্টা চালিয়েছেন। জাতির মধ্যে একটি নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে তাদের জাগিয়ে তুলতে সফল হয়েছেন। স্বল্পকালীন শাসনকার্য পরিচালনায় গভীর দেশপ্রেম, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার যে পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন তা আজও কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। এমনকি রাজনৈতিক বিরোধীরাও তার সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেনি। এ কারণেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের আপামর জনগণের অন্তরে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি দেশের সার্বিক উন্নয়ন করেছেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করার কার্যকর সময়ের মধ্যেই দেশে আইনের শাসন পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রের সব কাজের ক্ষেত্রে মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তন আনেন। দেশ গড়া ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। হেঁটে নিজে মানুষের সমস্যা দেখেছেন। দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা নিয়েছেন। জনগণকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দেশবাসী তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। সবাইকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য।
উন্নয়ন কার্যক্রমে সঞ্চারিত হয়েছিল দুর্বার গতি। সন্ত্রাসের করাল ছায়া থেকে মুক্ত স্বদেশে প্রথমবারের মতো বইল শান্তির সুবাতাস। অস্থিতিশীলতা থেকে উত্তরণ হলো স্থিতিশীলতা। অবসান হলো রাজনৈতিক শূন্যতার। প্রায় ১০ হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন তিনি। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতি দ্রুত?ই উল্লেখযোগ্য সাফল্য বয়ে আনে। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সব দলের অংশগ্রহণে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়। ফিরিয়ে দেওয়া হয় বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। দেশে কৃষি, গণশিক্ষা ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব শুরু হয়। তবে তার বড় অবদান বাংলাদেশের মাটিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের প্রকৃত পথ সৃষ্টি করা। তিনি চেয়েছিলেন কথিত সমাজতান্ত্রিক স্বৈরাচার থেকে বেরিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ, অভাব-অনটন আর অনাহার থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দেওয়া। আর সেজন্য তিনি জনগণের ক্ষমতায়নকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। এমনকি যারা বাংলাদেশের প্রকৃত শত্রু হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত, মূল রাজনৈতিক দলকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছিল যারা- দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদেরও পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেন তিনি। অন্তত জিয়াউর রহমানের এই উদারতার কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার সময় প্রথম এবং শেষবারের মতো বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল ও সফলতা।
২০২৪ সালে নির্বাচনের নামে নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রধান বিরোধী দলসহ ২০-দলীয় জোটকে বাইরে রেখে দুঃখজনক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক শক্তির পরিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণ আশা-আকাক্সক্ষাকে পাশ কাটিয়ে ডামি নির্বাচন সম্পন্ন করে। ডামি প্রার্থীরা ছিল তাদেরই ঠিক করে দেওয়া; পরিকল্পনার শতভাগ বাস্তবায়ন। আর এর মধ্য দিয়েই গুম, হত্যা, হামলা-মামলায় নির্যাতিত লাখ লাখ দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রকামী জনগণের সঙ্গে বেঈমানি করে দেশকে একটি বিপজ্জনক খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে তারা।
২০২৪ সালের নির্বাচন নামের প্রহসনে ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক গঠন করা হয় কিছু কিংস পার্টি। নির্বাচন শেষে জনগণের হাসির খোরাকে পরিণত হয় এসব কিংস পার্টির ব্যক্তিরা। পরিস্থিতি হয় অত্যন্ত হতাশাজনক। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শ। ঠিক সেই আদর্শ, যার মাধ্যমে একদলীয় অপশাসন থেকে বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছিল প্রকৃত মুক্তির পথ।
গবেষক, অধ্যাপক বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :