ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক প্রজন্ম

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০২:০০ পিএম

প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক প্রজন্ম

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

আমরা জানি শিক্ষা হলো জ্ঞান লাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তি সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশে অব্যাহত অনুশীলন। তাই শিক্ষার শেষ নেই। প্রচলিত দুটি কথা আছে যা মুসলিম শাসনামলে দার্শনিকদের মুখে শোনা যেত ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর’ বা ‘সুদূর চীনে গিয়ে হলেও বিদ্যা অর্জন কর’। বাক্যগুলো যেভাবেই আসুক না কেন এটা অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই জীবনের শুরু থেকে শেষ অব্দি জ্ঞান অর্জনই মানুষের প্রকৃত ধর্ম বলে আমি মনে করি; তবে অবশ্যই সেই জ্ঞান হতে হবে মানবজাতির কল্যাণে। জ্ঞান অর্জন করে মানুষ সভ্য জগতে পা রাখে, তৈরি করে সভ্যতার নিদর্শন। আচরণ, নৈতিকতা, শিষ্টাচার ইত্যাদি কেবল প্রকৃত শিক্ষা থেকেই প্রতিফলিত হয়। মানুষ জন্মগত জ্ঞানী, কিন্তু শিক্ষা অর্জন করে নিতে হয়। অর্জিত শিক্ষা সাধারণত দুই প্রকারের এক. সুশিক্ষা ও দুই. কুশিক্ষা। যে শিক্ষা ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের কল্যাণের নিমিত্তে অগ্রসরমান; মূলত সেই শিক্ষাকেই সুশিক্ষা বা প্রকৃত শিক্ষা বলে। আর যে শিক্ষা  স্বার্থান্বেষী, লোভী, ফ্যাসিবাদী ও চাটুকারদের নিমিত্তে আগ্রাসী; সেই শিক্ষাই কুশিক্ষা হিসেবে আখ্যায়িত।

গত কয়েক বছর পেছনের দিকে তাকালে আমাদের যে উপলব্ধি হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় অপরাধী মনে হয় নিজেদেরকে। বর্তমান সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা যে কতটা নাজুক তা ভাবা যায় না। অত্যন্ত কষ্ট ও বেদনাদায়ক মনে হয়, অথচ কিছুই করার ছিল না। আমরা জেনে বুঝে অন্ধ ছিলাম। আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কিছুই করার ক্ষমতা সাধারণের ছিল না। ভাষা প্রকাশ ও লেখার স্বাধীনতাটুকুও ছিল না। প্রতিবাদীরা কারাগারে বসবাস করেছে। ফ্যাসিবাদীদের দৌরাত্ম্য এতটাই ভয়ানক ও উদ্ধত হয়ে উঠেছিল। তাই প্রকাশ্যে কিছু করতে গেলেই গুম, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, পিটিয়ে-ঝুলিয়ে কিংবা টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেওয়া হতো জীবন্ত মানুষকে। এসব দৃষ্টান্ত দেখে দেখে শিশুরা বড় হচ্ছে। ভয় তাদের মধ্যে আতঙ্ক হয়ে দুর্বলতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। বিশাল আতংকের মধ্যে সময় কাটাতে হয়েছে; বিশেষ করে কোমলমতি শিশুদের।  

পড়াশোনার একটা পরিবেশ থাকে। যা এই সন্তানদের দিতে পারিনি বিগত বছরগুলোতে। এখনো পারছি না। আমরা নিজেরাও জানি না তারা কী করছে। তারা কী পড়ে? কতটা পড়ে? কোথায় পড়ে? এ সবই অজানা। যদিও বলতে বলতে পড়ার টেবিলে কিছু সময়ের জন্য বসে; নিঃশব্দ বইয়ের পাতায় চোখ মেলে রাখে। এর নাম কি পড়া? আজ পড়ার কোনো সাড়া শব্দ নেই, পরিবেশ নেই, প্রকৃতির দৃশ্যপটে ছবি আঁকা নেই। আছে শুধু কম্পিউটার, মোবাইল, টেলিভিশন, ট্যাব বা অন্য কোনো ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীলতা। বিজ্ঞান এগিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন, কিন্তু আমরা পড়ে আছি পিছিয়ে যাওয়া দলে। আমাদের মেধার বিকাশ নেই, প্রযুক্তিকে আমরা ঠেলে দিচ্ছি বিকৃত মানসিকতার দিকে। তাই প্রকৃত শিক্ষার আলো আমাদের মগজে সহসা পড়ে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে, এই কোমলমতি শিশুরা আরও দশ বছর পর কী করবে? দেশের এই করুণ পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী? হাল ধরার মতো মেধার অভাবে জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে। একটা নপুংশক জাতিতে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ কোন পথে’ গ্রন্থ থেকে আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যারের মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গি

গোটা শিক্ষাব্যবস্থারই মৌলিক সংস্কার দরকার। বর্তমান জরুরি অবস্থার সরকার দিয়ে তা হবে না। জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার কয়েম করা গেলে সেই সরকার দ্বারা এটা সম্ভব হবে। বর্তমানে প্রচলিত রাজনীতির ধারায় জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, তার জন্য দরকার উন্নত-চরিত্রের নতুন রাজনীতি। সমস্যা কঠিন সংকটে রূপ নিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সরকারি কর্মকাণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তৃত্ব কায়েম হওয়ার ফলে। তারা কি দেবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংস্কার দরকার সেই সংস্কার করতে? তাদের ইচ্ছানুযায়ী কতকাল আমরা চলতে পারব? এভাবে চলার পরিণতি কী হবে?’

একটি দেশের শিক্ষার মান নির্ভর করে সেই দেশের শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। গবেষণায় দেখা গেছে- মানসম্মত শিক্ষার ২০ (বিশ) শতাংশ নির্ভর করে অনুকূল পরিবেশ ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ওপর। আর বাকি ৮০ (আশি) শতাংশই নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। আন্তর্জাতিক স্কেলের মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২.৮; অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও শ্রীলঙ্কার মান ২০.৮ এবং পাকিস্তানের শিক্ষার মান ১১.৩। এই যদি শিক্ষার মান হয় দেশের; বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানো তো বহু দূরত্বের বিষয়।

জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে পাকিস্তান ১২৩তম, নেপাল১২৮তম, আফগানিস্তান ১৫১তম। আর বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা ৮৬তম, ভারত ৯৭তম ও ভুটান ১০৮তম।  ২০২৩ সালে ১৩৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২ ছিল। অন্যদিকে জাতিসংঘের সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের’ প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশি^ক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬তম। ২০২৩ সালে ১৩৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম।

জিনিসপত্রের দাম দিগুণানুপাতিক হারে বেড়েই যাচ্ছে। সেদিক বিবেচনা করলে শিক্ষকদের স্বল্প বেতনে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সংসারের ঘানি টেনে টেনে। কী করে ছাত্রদের ভালো দিকনির্দেশনা  দেবেন? নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা; তারা কতটাই বা সাপোর্ট  দেবেন। একজন শিক্ষককে তার নিজের চিন্তা যেন করতে না হয়; এটা আগে ভাবতে হবে। শিক্ষকের প্রকৃত সম্মান না থাকলে, ছাত্ররা কী করে প্রতিভাবান হবে? আর ছাত্রদের মেধার বিকাশ করতে গেলে শিক্ষকের মূল্যায়ন জরুরি। সেই সঙ্গে অভিভাবকদের দায়িত্ব অনেক; সন্তানদের মেধা বিকাশে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষ জীবনের অর্ধেক শিক্ষা অর্জন করে তার নিজঘর থেকে।  যেমন- শিষ্টাচার, সামাজিক মূল্যবোধ, আচরণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য, সহানুভূতিশীল ইত্যাদি ইত্যাদি। আর অর্ধেক আলোকিত করে তার শিক্ষক। শিক্ষকরাই মূলত আলোকিত মানুষ করে গড়ে তোলার কারিগর।

চলমান শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই সবচেয়ে বড় রকমের গলদ। অনিয়ম ও দুর্নীতির ফাঁদে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা। উপরের মহল থেকে নির্দেশ দেওয়া হতো কাউকে ফেল করানো যাবে না কিংবা কোনোরকম লিখলেই লেটার মার্ক দিতে হবে। এ ধরনের সত্যতা মিলেছে প্রকৃত শিক্ষকদের কাছ থেকে। তারা বোর্ডের খাতা দেখতে চান না কারণ অন্যায় সবার দ্বারা হয় না। এদিকে ছাত্ররা না পড়েই ভালো রেজাল্ট করছে। তাদের ধারণাকেও পাল্টে দিচ্ছে। একসময় আমরা বলে দিতে পারতাম কোন বিষয়ে কত পাব; এখন এরা তা পারে না। তাই ছাত্রদের যে দায়িত্ববোধ তা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে বর্তমান সময়ের পড়ুয়া ছাত্ররা। তারা কেবলই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। খুঁজবে প্রযুক্তি থেকে আরও উন্নততর কী আছে! মানুষের প্রকৃত মূল্যবোধ তাদের কাছে মূল্যহীন।

হাসান আজিজুল হকের ‘কথা লেখা কথা’ গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করা যায়

‘এ রাষ্ট্র বিশ্বসই করে না শিক্ষা সকলের জন্য। সব সময় রাষ্ট্র মুষ্টিমেয়ের। এর ব্যত্যয় কোনোদিনই হয়নি। স্বেচ্ছাচারতন্ত্র, সেনাতন্ত্র, গণতন্ত্র যা খুশি বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র জনগণের নয়। গত ত্রিশ বছর, তার আগে তেইশ বছর, তার আগে গোটা ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র কখনো জনগণের ছিল না। রাজতন্ত্রের বেলায় তো-প্রশ্নই ওঠে না। আমরা আক্ষেপ করি শিক্ষা সংকোচন করা হচ্ছে। তাই তো হবে। সেজন্যই বলছিলাম এ ব্যবস্থা এই রাষ্ট্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান সমাজব্যবস্থার জন্য খুবই উপযুক্ত। এই শিক্ষাব্যবস্থা শাসকদের, মালিকদের, জনগণের নয়। মধ্যবিত্ত বৃথায় চেঁচামেচি করে মরে পাত্তা না পাবার ক্ষোভে- কিছুতেই এটা তাদের মাথায় ঢোকে না যে, তারা ছিটেফোঁটা পাবে, ছুড়ে দেওয়া হাড় চুষবে আর বৃথাগর্বে স্ফীত হবে যে তারাই সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প ইত্যাদি চালাচ্ছে। রাষ্ট্র যদি জনগণের হতো তাহলে শিক্ষায় তাদের অলঙ্ঘনীয় অধিকার থাকত। যেহেতু তা নয় সেজন্য জনগণের শিক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।’  

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করতে হয় তার মূলেই শিক্ষাব্যবস্থা। যে যতবেশি শিক্ষিত, সে তত উন্নত- হোক সে জাতি, সমাজ বা দেশ। সময় চলমান, কোনো কিছুই থেমে নেই এই পৃথিবীতে। তাই প্রতিটি সেকেন্ডই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অবহেলায়-অবজ্ঞায় এই গুরুত্বপূর্ণ সময়কে অতিবাহিত করি। তাই পিছিয়ে আছি বিশ্ব অগ্রযাত্রায়। বাঙালি আরামপ্রিয় মানুষ, একবেলা কাজ করি তো অন্যবেলা বসে থাকি। আমরা মেরিটরিয়াস হলে কী হবে, আমরা অলস জাতি।

লেখক

আলাউল কবীর

কবি ও কথাসাহিত্যিক

আরবি/জেআই

Link copied!