ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

বীজ সিন্ডিকেটে নিঃস্ব হচ্ছে কৃষক

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম

বীজ সিন্ডিকেটে নিঃস্ব হচ্ছে কৃষক

ফাইল ছবি

কৃষির উন্নয়নে সুস্থ-সবল চারা এবং ভালো উৎপাদন পূর্বশর্ত। এজন্য ভালো মানের বীজ ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়। উন্নত জাত ও বীজের মান ভালো না হলে ভালো কৃষকের অর্থ, শ্রম, সময় যেমন নষ্ট হয় তেমনি ঘাটতি হতে পারে দেশীয় উৎপাদনের ওপরে।

কৃষকপর্যায়ে বীজের মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা উন্নত না হওয়া, কৃষকদের সচেতনতার অভাব, বাজারে বীজের মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতা, নিকটস্থ দোকান থেকে বীজ ক্রয়, এমনকি বীজের সিন্ডিকেটের ফলে ভেজাল বীজ কিনে দিনের পর দিন ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। এ ছাড়া মৌসুমে বীজের কৃত্রিম সংকটের ফলে ভেজাল বীজ বিক্রির ধুম চলে। তবে দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় খেটে খাওয়া গরিব চাষিরাই।

সম্প্রতি নামি-দামি কোম্পানি এমনকি সরকারি বীজ উৎপাদন সংস্থা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ভালো বীজ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মোড়ক পরিবর্তন করে বিক্রির ফলে কৃষকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষকরা মোড়ক দেখে বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। অবিকৃত মেয়াদ-উত্তীর্ণ বীজ নতুন মোড়কে স্থানীয়ভাবে মোড়কজাত করে আবারও বিক্রির ফলে আশানরূপ গাছ জন্মাচ্ছে না। জন্মালেও ফলন আসছে না। মোড়কে একটি জাত লেখা কিন্তু জন্মাচ্ছে অন্য জাত। সারা দেশেই প্রতিনিয়ত খবর পাওয়া যায় বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষক। কিন্তু কেন? কৃষকরা কেন বীজ কিনে প্রতারিত হবেন? এগুলো দেখার দায়িত্ব যাদের তারা কী করেন? আর কৃষকরা অভিযোগ করেই কী লাভ?

জেলা শহর, শহরতলী, উপজেলা শহর এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে রয়েছে বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠান। নামে-বেনামে অনুমোদিত এমনকি অনুমোদনহীন এসব বীজ বিক্রয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে মুনাফা অর্জন এবং কৃষকদের প্রতারিত করতে। তবে সব বীজই ভেজাল এ কথা ঢালাওভাবে বলা যায় না। কেননা ভেজাল বীজ শনাক্তকরণের যন্ত্র যেমন নেই কৃষকের হাতে, তেমনি নেই বীজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের হাতে। মূলত এখন বীজবাজার চলে হাওয়ার ওপরে। বিশ^াস করলে বীজ নেবেন আর না করলে নেবেন না। কিন্তু ভালো বীজের সন্ধানে সব সময়ই হন্যে হয়ে ঘোরেন কৃষক। বীজের মান বোঝা যায় তখনই যখন কৃষক কাক্সিক্ষত ফলন না পায়। অনেক সময় কৃষক বুঝতেও পারে না তার ব্যবহৃত বীজটি ভেজাল ছিল কি-না। কেননা এ সংক্রান্ত কোনো প্রকার প্রশ্ন তোলা হলে তার দিকে ছুড়ে দেওয়া হবে হাজারো প্রশ্নের তীর। কীভাবে জমি চাষ করেছিলেন, কখন সেচ দিয়েছিলেন, কী ধরনের সার দিয়েছিলেন, কতবার নিড়ানি দিয়েছিলেন, ক্ষেতে ঠিকমতো কীটনাশক দেওয়া হয়েছিল কি-না। এমন হাজারো প্রশ্ন এড়িয়ে চলতে কৃষক আর কোনো প্রকার অভিযোগ তুলতে সাহস পায় না। তার ওপরে রয়েছে বীজ ব্যবসায়ীদের বিশাল এক সিন্ডিকেট।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, মোবাইলে ফোন আসে এক কৃষকের কাছ থেকে। ৬০ বিঘা জমিতে লাভের আশায় কৃষি অফিসের পরামর্শে ও ইউটিউবে ভিডিও দেখে জমি বর্গা নিয়ে কয়েকজন কৃষক তরমুজের চাষ করেছেন। নামি একটি বীজ কোম্পানির এক জেলার এজেন্টের মাধ্যমে তরমুজ বীজ কেনেন। পরে প্রায় ৬০ বিঘা জমিতে এসব বীজ বপন করেন। বীজ থেকে সময়মতো চারা গজিয়ে লতানো গাছে ক্ষেত ছেয়ে যায়। ফুলও ধরে। কিন্তু তরমুজ ধরে না। দু-একটি গাছে একটি-দুটি তরমুজ ধরলেও তা আকারে খুবই ছোট। বীজ কোম্পানির পরামর্শমতো কৃষকেরা ঠিক সময়ে সার, কীটনাশক দিয়েও কোনো ফল পাননি। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন চাষিরা। পরে জানতে পারে যে, বীজগুলো ছিল মেয়াদ-উত্তীর্ণ। পরে এ ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেও কোনো ফল পায়নি কৃষকরা। নষ্ট হয় কৃষকের তরমুজ ক্ষেত, আশা ভেঙে যায়। এরপরে ওই এলাকায় আর চাষ হয়নি তরমুজের।

অনুমোদিত খুচরা সার-বীজ বিক্রেতার কাছ থেকে ধান বীজ কিনে মৌসুম শেষ হয়ে গেলেও ধানের শীষ বের না হওয়ায় গরুর ঘাস হিসেবে কেটে ফেলে কৃষক। পরে অভিযোগ করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতে মাত্র ১০ হাজার টাকা জরিমানা হয়। কিন্তু প্রতারিত কৃষকের কোনো লাভই হয়নি।
কৃষির রবি, খরিপ-১ এবং খরিপ-২ মৌসুমের মধ্যে রবি মৌসুমে শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন বেশি হয়। আবাদ ও ফলন দুই-ই ভালো হয় বোরো ধানের। রবি মৌসুমে শাক-সবজির বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষকরা প্রতিনিয়ত। খোলা বাজারে শাক-সবজির বীজ বিক্রির ধুম চলে। এই বীজ বাজার থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে নামমাত্র মোড়কজাত করে আবার বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে কৃষকদের প্রতারিত করে কিছু অসাধু বীজ ব্যবসায়ীরা। বছরের পর বছর অবিক্রীত সবজি বীজ ফেলে না দিয়ে নতুন করে আবার বাজারজাত করার ফলে সেই বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষকরা।

রবি মৌসুমে বোরো ধানের বীজের চাহিদা বেশি থাকে। এর সুযোগ নেয় অসাধু ব্যবসায়ী। যে বীজের চাহিদা বেশি থাকে তার কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ানো হয়।

২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, মৌসুমে আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুমে দেশে ধান বীজের চাহিদার তুলনায় সরকারি সংস্থা (বিএডিসি, ডিএই, বিএমডিএ) এবং বেসরকারি সংস্থা মিলিয়ে শতকরা ৬৪ ভাগ বীজের জোগান দিয়েছিল। বাকিটা কৃষক স্থানীয়পর্যায়ে উৎপাদন করে। গড়ে দেশের চাহিদার ৩০ ভাগ বীজের জোগান ছিল। বাকি কৃষকদের চাহিদা মিটেছিল কৃষকপর্যায়ে উৎপাদিত বীজ থেকে।

একদিকে যেমন বাজারে বীজের সংকট দেখিয়ে দফায় দফায় নীরবে দাম বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে সংকটে ভেজাল বীজ বিক্রি বেশি হয়। এমনকি সরকারি বিএডিসির বীজ কিনেও কোনো কোনো সময় প্রতারিত হয় কৃষকরা। তবে সব বীজ ভেজাল তা কিন্তু নয়। কৃষি প্রণোদনার বীজে আস্থা রেখেও কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে ভেজাল ও মেয়াদ-উত্তীর্ণ বীজ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। বীজবাজির হাত থেকে সাধারণ কৃষকদের রক্ষা করবে কে? আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, গবেষণায় নতুন জাত সৃষ্টি, উচ্চফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধী বিভিন্ন জাত উদ্ভাবন, আধুনিক কৃষিসেবা, বীজ উৎপাদনে জোরদারসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাজারে ভেজাল বীজ বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাও করছে। কিন্তু তার পরেও কেন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা?

ভেজাল বীজে বাজার সয়লাব। প্যাকেটের গায়ে উৎপাদনকারী, সরবরাহকারী, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম নেই। নেই বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সিল। এজেন্সির লাইসেন্স থাকলে যে কেউ এভাবে প্যাকেটজাত ধান বীজ হিসেবে বিক্রি করতে পারেন। বীজ প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসে আছে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বীজ ব্যবসায়ীরা।

কৃষক বাঁচলে বাঁচবে আমাদের বাংলাদেশ। দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বীজ সিন্ডিকেট ধ্বংস করে ভেজাল বীজ বিক্রি বন্ধ করতে করা সময়ের দাবি।  

লেখক

মানিক মজুমদার 

আইনজীবী, কলাম লেখক
 

আরবি/জেআই

Link copied!