ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

মনুষ্যত্বের বিপরীত যাত্রায় বিপজ্জনক পথ

মামুনুর রশীদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০৫:৩৭ পিএম

মনুষ্যত্বের বিপরীত যাত্রায় বিপজ্জনক পথ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দুর্বলের প্রতি মানুষের নৃশংসতার আরও দুটি প্রমাণ পাওয়া গেল দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এ ঘটনা দুটি ঘটেছে। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুকসহ সব জায়গাতেই প্রচার হয়েছে। শত শত মানুষের আত্মত্যাগের পটভূমিতে এ ধরনের ঘটনা শুধু অনভিপ্রেতই নয় একেবারেই আশ্চর্য হওয়ার মতো। একজন ব্যক্তিকে চোর সন্দেহে আটক করা হলো সাবেক ছাত্র কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, তাকে খাবার খাইয়ে তারপর পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনাটিও কোনো সন্দেহ ছাড়াই কী কারণে পিটিয়ে হত্যা করা হলো তা বুঝা গেল না। সম্প্রতি বিভিন্ন বিদ্যাপীঠে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যগ করানোর হিড়িকও দেখা গেছে। এসবই জাতীর মূল্যবোধের বিপরীতে। মানুষ গড়ার কারিগর এসব শিক্ষাঙ্গনে মনুষ্যত্বের বিপরীতে ঘটনাগুলো রীতিমতো উদ্বেগজনক। আবার ধর্মীয় উপাসনালয়ে দুপক্ষের মারামারি করার মতো ঘটনাও উদ্বেগজনক সৃষ্টি করে। এসবই ‘মব জাস্টিসে’র চূড়ান্ত পর্বে সহিংসতার প্রমাণ। অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই নিয়েছে এবং সবশেষে সামরিক বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেটের মর্যাদা দিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে। আরেকটি বিষয় ভয়ঙ্করভাবে দৃষ্টিকটু লেগেছে মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল গত ৫ আগস্ট। সর্বত্র বিক্ষুব্ধ জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল এবং পরবর্তীকালে তা লুটপাটের সূচনা করে। যদিও ক্ষমতার পালাবদলের ক্রান্তিকালে লুটপাট নতুন কোনো ঘটনা নয়। ইতিহাসে আমরা এর পুনরাবৃত্তি বারবার দেখেছি। আবার এ উপমহাদেশ লুটেরাদের অত্যাচারে বারবার জর্জরিত হয়েছে।

১৭৩৯ সালে নাদির শাহ্ দিল্লি লুণ্ঠন অথবা বারবার নবাব আলীবর্দী খাঁর সময় বর্গীদের বাংলা আক্রমণ এবং লুণ্ঠন আমাদের ইতিহাসে একটা বড় অধ্যায়জুড়ে মানুষের অসহায়ত্বের কাহিনি বর্ণনা করে। এরপরও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর ব্রিটিশ সৈন্যরা যেভাবে মুর্শিদাবাদের খাজাঞ্চিখানা লুণ্ঠন করে তা রবার্ট ক্লাইভের বাহিনী নৃশংসতার বর্ণনা একজন ব্রিটিশ সৈনিকের মুখ থেকেই জানা যায়। কর্নেলি নামে একজন ব্রিটিশ সৈনিক তার লোহমর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। আমরা জানি মুর্শিদাবাদের রাজপ্রাসাদ এবং খাজাঞ্চিখানা লুণ্ঠন করে সেসব লুটের মালামাল কলকাতায় নেওয়া হয়েছিল এবং পরে তা লন্ডনে পাচার করা হয়। এই পাচারকৃত অর্থে রবার্ট ক্লাইভ ইংল্যান্ডের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী হিসেবে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর ক্ষমতাসীনদের ঘরবাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করার ঘটনা নতুন নয়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের আগে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এক নৃশংস দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ২০০ বছরের শাসক ব্রিটিশের তাতে সামান্যও আঘাত লাগেনি। কিন্তু এ দেশের হিন্দু-মুসলমানদের রক্তে ভেসে যায় হাজার বছরের সম্প্রীতি। এক অমানবিক হত্যাযজ্ঞে ও লুণ্ঠন কাজে মেতে উঠে উপমহাদেশের কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। মানুষ তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পরস্পর পরস্পরকে শুধু হত্যা করেই না সম্পদ লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে অংশ নেয়। এরপরে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিপীড়ন ঘটতে থাকে। এ ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে সংখ্যালঘুদের অভিবাসনের নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়। মাঝে মাঝে মন্দিরে হামলা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনায় আমরা দুঃখিত হয়েছি, প্রতিরোধ করার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু এই প্রবণতা এখনো শেষ হয়নি। আবার এও লক্ষ করা যাচ্ছে একই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সংঘাতের প্রবণতা এক নতুন নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে, যা ছিল সুপ্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও অনুপস্থিতির সময়ে তা জীবন্ত হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি মাজার ভাঙার যে চিত্র দেখা গেল তাতেও আমরা বিস্মিত, মর্মাহত এবং অসহায়বোধ করি। উপমহাদেশে মাজার-সংস্কৃতি সুপ্রাচীন। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে যেসব মহৎ মানুষেরা নিম্নবর্গের মানুষদের লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিয়েছিল এবং তাদের ভক্তরা মৃত্যুর পরে কবরকে কেন্দ্র করে স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। এটি শুধু তার প্রতি কৃতজ্ঞতা নয়, মানবজাতির কল্যাণের জন্য এক নিরন্তর প্রেরণা এবং ভালোবাসার নিদর্শন। যুগ যুগ ধরে তার ভক্তকুল এসব স্মৃতিস্তম্ভে এসে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করে। তাদের প্রার্থনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং কখনো কখনো সংগীতময়। সংগীত যখন মানুষের অন্তরাত্মার ভেতরের শুভ-সুন্দরের বহিঃপ্রকাশ করে তখন সংগীতও পবিত্র হয়ে ওঠে। উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ আমীর খসরু হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার শিস্য ছিলেন। হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুর পর তিনি এতই দুঃখ পেয়েছিলেন, তার সমাধির পাশে কয়েকদিন পরেই তিনি মারা যান। শুধু তাই নয় ভারতবর্ষে অসংখ্য পীর-আউলিয়ার মাজারকে কেন্দ্র করে শান্তির সুবাতাস বইত। সব ধর্মের মানুষ এসব মাজারে গিয়ে তাদের আকাক্সক্ষার কথা বর্ণনা করত। হযরত শাহ্জালালের মাজারে কিংবা হজরত মঈন উদ্দিন চিশতির মাজারে মুসলমান ছাড়াও অন্য ধর্মের মানুষের সংখ্যা কখনো বেশি হয়ে যায়। সম্প্রতি মাজার ভাঙার জন্য উন্মত্ত প্রতিবাদ দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। এরা ধর্মের মহান বাণীর চাইতে হিংসা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ এসবে পরিণত করেছে। আজকের দিনে এসব কথার অর্থই হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে একটা অনগ্রসর এবং প্রতিশোধ স্পৃহার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর জন্য কাকে দায়ী করব? প্রথম দায়টি পড়ে শিক্ষার ওপর। প্রথমেই যে ঘটনাগুলোর বর্ণনা করা হয়েছে যার স্থান হচ্ছে বিদ্যালয়। তাই বিদ্যালয়ের প্রথম পাঠ সংস্কৃতির বিনিময়ে প্রতিহিংসারই চর্চা দেখা যায়। আর প্রতিহিংসার উদগীরণ ঘটে প্রযুক্তির মাধ্যমে। ফেসবুকে কোনো বানানো আইডি থেকে একটি মন্তব্যকে ঘিরে কয়েকটি মন্দির ধ্বংস হয়ে গেল। অথবা প্যাগোডায় বুদ্ধের মূর্তি ভাঙচুর করা হলো কিংবা কোনো গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হলো। এসব আমাদের সমাজে নিত্যনৈমত্তিকভাবে ঘটে চলেছে। কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যক্রম পদক্ষেপ নিতে পারেনি। পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে এসবকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলের সদস্যদের শিক্ষিত করে তোলা পরমত সহিংসতা সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোভাব এসবের ওপর দীর্ঘ দীর্ঘ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই আলোচনার বিপরীতে প্রতিশোধ স্পৃহাকে জাগ্রত করার একটা বড় উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সংস্কৃতির শিক্ষাও একেবারে শৈশব থেকে পারিবারিক জীবনে এবং পরবর্তীকালে শিক্ষা জীবন ও কর্মজীবন পর্যন্ত প্রসারিত হওয়া উচিত। সেই লক্ষ্যে আমাদের পাঠক্রমও পুর্নবিন্যাস করা প্রয়োজন। কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপের কাছে পাঠক্রমের সমর্পন সব সময়ই আত্মঘাতী হয়ে পড়ে। একেবারেই সত্যিকারের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা বা রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ছাড়া শিক্ষা পাঠ্যক্রম বিবেচনা করা দরকার।

একটা কথা মনে রাখা দরকার মানবজাতি কখনো অন্য জাতিকে পরাজিত করার জন্য অস্ত্র ও সহিংসতা গ্রহণ করেছে। আজকের দিনেও আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নিষ্ঠুরতা দেখতে পাই। সম্প্রতি প্যলেস্টাইনের ওপর ইসরাইলের যে নৃশংসতা তা সভ্যতাকে কলঙ্কিত করেছে। একইভাবে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় হত্যা, গণহত্যা ও নৃশংসতা চলছে। কাজেই এ কথা সত্য সভ্যতা যতই অগ্রসর হোক মানুষের ভেতরে যে নৃশংসতা তা এখনো অক্ষুণ্ন আছে। অর্থাৎ অমানবিক গুণগুলো নিয়েই সভ্যতা অগ্রসর হয়েছে। আবার কিছু কিছু দেশ অতীতে বর্বর থাকলেও তারা এর ভয়াবহতা লক্ষ্য করে নিজেদের পরিশালিত করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি আমরা জাপান। আমাদের দেশে এসবের কারণ মূলত শিক্ষাব্যবস্থাটা এবং রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তি ও গণতন্ত্রের অভাব। ধর্ম মানুষের শান্তির জন্য, ধর্মকে শান্তির প্রয়োজনে ব্যবহার করাটাই হবে মানুষের মুক্তির উপায়। মাজার ভাঙার সময় যে উন্মাদনা লক্ষ করেছি, তা ইসলাম ধর্মে একেবারেই উল্টো পথে যাত্রা। এই উল্টোপথের যাত্রাকে থামিয়ে আমাদের সহনশীল এবং সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে হবে। মনুষ্যত্ববিনাশী এই নৃশংসতার অবসান অত্যন্ত জরুরিভাবে কাম্য। হিংসায় উন্মুত্ত বৃত্তিকে শান্তির সুশীতল আশ্রয়ে নিয়ে আসতেই হবে। তবে পাওয়া যাবে এক শান্তিময় ধরনী। 

আরবি/এফআই

Link copied!