ঢাকা শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার নতুন ক্ষেত্র আফ্রিকা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার নতুন ক্ষেত্র আফ্রিকা

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

বিশ্বায়নে যুগে বিশ্বের ছয়টি মহাদেশ এখন এক সুতোয় বাঁধা। বিশ্ব আধিপত্যবাদ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। অতীতেও পরিবর্তন এসেছে। ঠিক অর্ধশত বছর আগে ইউরোপ বা পশ্চিমা দেশগুলো এশিয়া নিয়ে যে ধরনের পরিকল্পনা সাজিয়েছে এখন তার ধরন বদলে গেছে। আবার আফ্রিকা নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। পরাশক্তিগুলোর নজর এখন আফ্রিকায়। কেন পরাশক্তিগুলো আফ্রিকার দিকে মনোযোগ দিয়েছে সেটি বোঝার আগে দরকার আফ্রিকা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা। অবশ্য আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের বা আফ্রিকাকে নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো আরও অনেক বছর আগেই শুরু হয়েছে। বছরের পর বছর আফ্রিকায় একতরফা রাজত্ব করেছে ইউরোপীয়রা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ হয় মার্কিনীরা। এতদিন ইউরোপ-আমেরিকা মিলে আফ্রিকায় রাজত্ব করলেও দিন দিন তাদের প্রভাব কমছে। কারণ ঠিক একই সময়ে চীন, ভারত, তুরস্কসহ আরও কয়েকটি দেশ অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তিতে উত্থান ঘটেছে এবং বিশ্বে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে।

এক সময় আফ্রিকার অনেক দেশ উপনিবেশ হিসেবে বহু বছর পার করেছে। উনিশ শতকের শেষ দিকে মহাদেশটির উল্লেখযোগ্য অংশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশে পরিণত হয়। উপনিবেশকাল কাটিয়েও সেসব দেশের প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। পৃথিবীর মোট ভূ-পৃষ্ঠের ৬ শতাংশ ও মোট স্থলভাগের ২০ শতাংশ নিয়ে গঠিত আফ্রিকা মহাদেশের মোট চুয়ান্নটি দেশ। এসব দেশ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার রয়েছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। কিন্তু আফ্রিকার অর্থনীতি দুর্বল হওয়ায় সম্পদের সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। উন্নত দেশগুলোর এখন আফ্রিকার প্রয়োজন। সেটা অর্থনীতি এবং সমরনীতি উভয়ের জন্যই। এশিয়ার পরে আফ্রিকাতেই বিশ্বের বেশি মানুষ বসবাস করছে। আফ্রিকার অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। এরপর রয়েছে খিস্টান এবং সেখানকার নিজস্ব কিছু ধর্মের অনুসারী মানুষজন। আফ্রিকার কয়েকটি দেশের অভ্যন্তরে রয়েছে গৃহবিবাদ।

আফ্রিকার সম্পদের দিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি রয়েছে। রয়েছে তীব্র প্রতিযোগিতাও। অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির বিকাশে সহায়তা করার মাধ্যমে এসব দেশ ঋণ কাঠামোও ভারি করছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন রয়েছে। তবে আফ্রিকার কিছু দেশে রাজনৈতিক মতবিরোধ প্রবল। আফ্রিকায় অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে অঞ্চলটির সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্য বিনির্মাণে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র আলাদা প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। চীন আফ্রিকা ফোরাম, ভারত আফ্রিকা ফোরাম নামে আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেছে। এক সময় কোনো দেশে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যম ছিল সামরিক শক্তি। এক দেশ অন্য দেশে সরাসরি আক্রমণ করত। দেশটিকে তৈরি করা হতো উপনিবেশ। কালক্রমে সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। এখন কৌশল মিত্রতার। বিভিন্ন কৌশলগত চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়।

সেটি বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক। ধারণা বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনার ধারা যেমন কূটনীতি এবং সমরনীতি পাল্টেছে। কিছুদিন আগেই শি জিন পিং নতুন করে আফ্রিকায় আরও ৫১ বিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা ও অন্তত ১০ লাখ কর্মসংস্থার সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। শি জিনপিং জানান, তিনি বেইজিংকে গ্লোবাল সাউথের পছন্দের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে এগিয়ে নিতে চান। তিনি বলেন, বেইজিং আফ্রিকার দেশগুলোতে নতুন করে ৫১ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা প্রদান করবে, যা বিভিন্ন ঋণ ও অন্যান্য সহায়তা প্যাকেজ আকারে দেওয়া হবে। এসব ঋণ ও সহায়তা আফ্রিকাজুড়ে সংযোগ বাড়াতে ৩০টি অবকাঠামো প্রকল্পে সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে কার্বন নিঃসরণের হার কমাতে আফ্রিকা মহাদেশের সবুজ 
জ্বালানি শক্তি নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ করবে চীন। এটিকে বিশ্বে পরাশক্তি হিসেবে চীনের শক্তি বৃদ্ধির প্রয়াস হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিকও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও গত শতকের সত্তরের দশকে জাতিসংঘে আবার যোগ দিতে আফ্রিকান দেশগুলো চীনকে সহায়তা করেছিল।  

২০০০ সালে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ফোরাম অন চীন-আফ্রিকা কো-অপারেশন সংস্থাটি। এরপর থেকেই প্রতি তিন বছর পর পর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারের সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বেইজিংয়ের প্রধান মিত্র রাশিয়ার সহযোগিতা ছাড়াই আফ্রিকা মহাদেশে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে বেইজিং। সেই সঙ্গে চীনের প্রবল জনসংখ্যা সংকট এবং অর্থনীতি ধীরগতি আফ্রিকা মহাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তারের অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি সেন্টার সংকলিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে আফ্রিকার দেশগুলোকে দেওয়া চীনের ঋণ ২০২২ সালের তুলনায় তিনগুণের বেশি বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে আফ্রিকার অতি ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর ঝুঁকি হ্রাসে আগ্রহী চীন।

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০০০-২৩ সালের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশে মোট ১৮ হাজার ২২৮ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। বেশিরভাগ অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে আফ্রিকার জ্বালানি, পরিবহন ও আইসিটি খাতে। বিশ্ব শক্তি হিসেবে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে চীন তার কূটনৈতিক তৎপরতায়ও বৃদ্ধি করেছে। পশ্চাৎপদ আফ্রিকার দেশগুলোর অর্থনীতির পরিবর্তনে এটি মাইলফলক হতে পারে বলে আশাবাদী আফ্রিকার নেতারা। যদিও এখনো অনেক দেশের নেতাদেরই চীনের এসব ঋণ গ্রহণে আপত্তি রয়েছে। এমনকি অতিরিক্ত ঋণের কারণে অনেক দেশই নতুন ঋণের প্রস্তাব ফিরিয়েও দিচ্ছেন। তবুও মহাদেশটিতে দিনের পর দিন চীনের আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখছে বেইজিং। এ অঞ্চলে চীন-ভারত দুদেশই প্রতিযোগিতায় রয়েছে। আফ্রিকায় মনোযোগ দিতে পিছিয়ে নেই তুরস্ক। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণে তুরস্ককে এ ক্ষেত্রে চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী বলে মনে করা হচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশে তুরস্কের কৌশলগত অবস্থান বাড়াতে সম্প্রতি তুরস্ক বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

সোমালিয়ায় অফশোর তেলের খনি সন্ধান ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেখানে একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকেন্দ্র চালুর চেষ্টা করছে তারা। ১৯৯৮ সালে আফ্রিকান ইনিশিয়েটিভ পলিসি গ্রহণ করার মাধ্যমে অঞ্চলটিতে বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তিগুলো দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে কাজ করছে তুরস্ক। এই নীতির অধীনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তুরস্ক সরকার প্রচুর শক্তি সঞ্চয় ও পরিকল্পনা করেছে। অর্থাৎ আফ্রিকা মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছে আরও তিন-চার দশক আগেই। তবে এখন প্রতিযোগিতা বেশি চোখে পড়ছে। এর কারণ হলো- বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতার ধরন এবং কৌশলের পরিবর্তন। ২০০২ সালে আফ্রিকায় তুরস্কের দূতাবাস ছিল ১২টি, যা দুই দশক পর ২০২২ সালে এসে ৪৪-এ উন্নীত হয়েছে। তুরস্কের বাইরে তাদের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসুতে। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ে কয়েকটি চুক্তির পর মোগাদিসু তুরস্কের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।

এই যে প্রতিযোগিতামূলক কৌশলের একটি বড় সুবিধা রয়েছে। সেটি হলো উন্নয়ন। যে দেশটি উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে ও বিপরীতে রয়েছে বিপুল সম্পদ এবং সেই সম্পদকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা থাকে না, তখন সক্ষম উন্নত দেশ সে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে তা উন্নয়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। আমরা এটাকে কৌশল বললেও আধুনিক বিশ্ব বিনির্মাণে এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এ কথা সত্যি যে, এই কৌশলে সব সময় যে লাভবান হওয়া যায় এমনও না, তবে এর কারণ রাজনৈতিক সততা এবং দূরদর্শিতার অভাব, অন্য কিছু না। কারও কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে তা কাজে লাগানোর ক্ষমতা না থাকলে ফলাফল ব্যর্থ হবে। আর যদি সে সুযোগ কাজে লাগানো যায় তাহলে তা মঙ্গলজনক। অতএব, এই ভূ-রাজতৈক প্রতিযোগিতা পৃথিবীর জন্য একেবারে খারাপ কিছু না। তবে অশুভ হলেই পৃথিবীর জন্য মহাবিপদ!

 

আরবি/জেআই

Link copied!