ঢাকা শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

দানবের প্রতাপে মূল্যহীন প্রাণ

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৪, ০১:০৪ পিএম

দানবের প্রতাপে মূল্যহীন প্রাণ

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সড়কগুলো এখন ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। ‘একটি দুর্ঘটনা মানে সারা জীবনের কান্না’- এটা স্লোগান হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এর মর্মবাণী কেউ উপলব্ধি করেছে বলে মনে হয় না। তা না হলে সবাই কেন যানবাহন নিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে?

সড়কগুলোতে প্রতিনিয়ত বিচিত্রসব যানের মধ্যে যেন গতির প্রতিযোগিতা চলে। কে কার আগে যেতে পারবে, কে কত দ্রুত পৌঁছতে পারবে। কীসের এত তাড়া? তাড়া না তাড়না? একের পর এক ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তরতাজা প্রাণগুলো অকালে মর্মান্তিকভাবে ঝরে যাচ্ছে, কত বাবা-মা স্বজন-প্রিয়জনের কত স্বপ্ন কত আশা-আকাক্সক্ষা চুরমার হয়ে যাচ্ছে- তবু হুঁশ হচ্ছে না কারও! সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে এত প্রচার এত সভা সেমিনার অনুষ্ঠান রোড শো- পই পই করে এত বোঝানো এত টাকা-পয়সা খরচ- সব বৃথা! কেউ শুনবে না বুঝবে না। রাস্তায় চলতে ফিরতে নিজেদের নিরাপত্তার কথাটাও ভাববে না মানুষ! লোকে বলে, প্রাণের মায়া নাকি সবচেয়ে বড় মায়া। এখন তো দেখেশুনে মনে হচ্ছে- প্রাণের মায়াটাও বোধহয় আর আগের মতো নেই। এখন প্রাণের মায়া ছাপিয়ে উঠছে এক ধরনের তাড়না, উন্মাদনা। আর তার মোহে পড়ে প্রাণের মায়া জীবনের মূল্য সব তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে। বড় হয়ে উঠছে ঝড়ের বেগে উড়ে চলার সাময়িক রোমাঞ্চ, গতির উন্মাদনা। আর এই উন্মাদনার আনন্দ অনেক ক্ষেত্রেই শেষ হচ্ছে বুকফাটা বিলাপে। কিন্তু, তাতেও পরিস্থিতি বদলাচ্ছে কই? উদ্দাম গতির উত্তেজনা উপভোগ করতে গিয়ে মৃত্যুর ফাঁদে পড়ে একের পর এক জীবন তো হারিয়েই চলেছে।

বিশ^ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট প্রভৃতি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে কমপক্ষে ১০-১২ হাজার মানুষ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এ তথ্য পিলে চমকে দেওয়ার মতো। অথচ এটা নিয়ে আমাদের প্রশাসন বা চালকদের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই।

বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিশে^ সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম গাড়ি ব্যবহার করে। সবচেয়ে কম গাড়ি ব্যবহার করেও সর্বাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। তারপরও আমাদের কোনো হুঁশ নেই।

ঢাকা নগরের জনাকীর্ণ রাজপথে প্রতিনিয়ত কত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, হাত-পা খোয়াচ্ছে, তা নিয়ে কি খুব বেশি ভাবি আমরা? এ যেন ডাল-ভাত। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার দুই কলেজশিক্ষার্থী সড়কে বাসচাপায় প্রাণ হারানোর পর শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর আগে রাজীব নামে এক কলেজছাত্র দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারালে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এমন দু-একটা ঘটনা কদাচিৎ আলোড়ন তোলে, তারপর তা হারিয়ে যায় অন্য কোনো ইস্যুর অতলে। আমরা দেখি, বুঝি, উপলব্ধি করি, তারপর মুখ ঘুরিয়ে ফেলি। সামনে কত ঘটনা, কত সমস্যা, একটা নিয়ে পড়ে কে থাকে?

বিভিন্ন সংস্থা কিংবা ব্যক্তিপর্যায় থেকে বহুবার সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিকারের উপায় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার পরও এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। যান চালকদের বিরুদ্ধে একটু কড়াকড়ি করলেই সবকিছু অচল করে দেওয়া হয়। সরকারও নতজানু মনে হয় পরিবহন-সন্ত্রাসীদের কাছে! নিয়ম-নীতি-আইন-সব তুচ্ছ। স্বেচ্ছাচারিতা, হাত-পা-শরীর ক্ষতবিক্ষত হওয়া আর মৃত্যুই যেন শেষ কথা! এটাই কি আমাদের একমাত্র ভবিতব্য? কোথায় নিদান? কোথায় এই দুর্ঘটনা ঠেকানোর উদ্যোগ?    

১৯৮৯ সালে দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু মতিঝিলের আনন্দ ভবন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন। ১৯৯১ সালে তার স্ত্রী রওশন আরা আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২৫ বছর পর ২০১৪ সালের ২০ জুলাই সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কাউকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে রায় ঘোষণা দেশে এটিই প্রথম। ভাবা হয়েছিল, আদালতের এই রায়ের পর পরিস্থিতি বদলাবে। সরকার উদ্যোগী হবে। চালকরা সতর্ক হবে! কিন্তু কোথায় কী?

আইনকেও এখন ঠুঁটোজগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছে। আর তা ছাড়া সবাই তো আর মামলা লড়ে না, ক্ষতিপূরণও পায় না। ক্ষতিপূরণ পেলেই বা কী? টাকা-পয়সা দিয়ে কি জীবনের ক্ষতিপূরণ হয়?

প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বেপরোয়া গতির মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষজনকে। নিরাপত্তার প্রাথমিক শর্তগুলো উপেক্ষা করাতেও কত যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে তা বলে শেষ করা যাবে না। বেশ কিছুদিন ধরেই ঢাকা শহর ও শহরতলিতে এমনকি গ্রাম মফস্বলেও এক শ্রেণির বাইকের আমদানি হয়েছে যার আরোহীরা হেলমেট সিগন্যাল আইনকানুন পুলিশ- কিছুরই তোয়াক্কা করে না। বিদ্যুৎগতিতে বাইক চালিয়ে দিনরাত শহর তোলপাড় করেই তাদের আনন্দ। তীব্র গতিতে বাহন চালিয়ে ততধিক জোরে হর্ন বাজিয়ে মানুষকে কষ্ট দেওয়াই যেন একশ্রেণির তরুণদের বিকৃত আনন্দ। দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনা ঘটছে, মৃত্যুর পর মৃত্যু- কিন্তু এই বিদ্যুৎগতির বাইকের উৎপাত কমছে না! শুধু বাইকই নয়, সব যানই এখন দুরন্ত গতিতে ছুটে চলতে চায়। যেন উলকার গতিতে ছুটে চলাটাই জীবন, মৃত্যু কোনো ব্যাপারই নয়!

সেই ছোটবেলায় পড়েছিলাম, গতি জীবন স্থিতিই মৃত্যু। তাই চরৈবেতি চরৈবেতি। সেই মন্ত্রেই যেন দীক্ষা নিয়েছে আজকের সব বয়সের সব শ্রেণি-পেশার নারীপুরুষ! উদ্দাম উল্লাসময় গতির দীক্ষা! অবশ্যই সকলে নয় কিন্তু অনেকেই। তবে, চরৈবেতি মানে তো আজ কেবল এগিয়ে চলা নয়, সবাইকে টপকে, সব রেকর্ড তছনছ করে জীবন বাজি রেখে প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ছুটে চলা! আর সেই গতির আনন্দে মাতোয়ারা নেশায় বুঁদ জীবনগুলো তাৎক্ষণিক আবেগের আতিশয্যে রকেটগতির উন্মাদনায় ভুলেই যাচ্ছে- বাইকের চাকা দুটোকে অভিজ্ঞজনেরা কেন বলেন ‘শয়তানের চাকা’, কেন রাস্তায় গাড়ি চালাতে এত বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে সরকার! আসলে, সব যেন কেমন বেপরোয়া, বেহিসেবি, লাউড হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সে রাজনীতিই হোক কি জীবনযাপন- সর্বত্র সবসময় একটা যেন  হৈহৈ-চইচই হুল্লোড়-হুড়োহুড়ির প্রবণতা। আর কী আশ্চর্য, এই প্রবণতার এমন সব নির্মম নিষ্ঠুর পরিণতি দেখেও বেখেয়াল জনতা! বেখেয়াল কর্তৃপক্ষ! দেখেশুনে মনে হয়, ভাবনাচিন্তার কোনো অবসরই যেন আর অবশিষ্ট নেই আমাদের জীবনে!

কিন্তু, গতির উন্মাদনায় এভাবে আর কত প্রাণ খোয়াব আমরা? কত মানুষের, কত প্রতিভার এমন অপমৃত্যু দেখব? আইন আছে, পুলিশ আছে। তা সত্ত্বেও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে যেন সব কেমন ঢিলেঢালা, অগোছালো! একটা দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুদিন একটু কড়াকড়ি, তারপর যে-কে-সেই।

বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও পরিসংখ্যানের আলোকে গতিকেই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বড় বড় শহর এবং পথচারীবহুল এলাকাগুলোয় যানবাহনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।  কয়েক বছর আগে এ সংক্রান্ত স্টকহোম ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী যেসব সড়কে লোক সমাগম বেশি হয়, যেখানে পথচারী ও যানবাহন একইসঙ্গে চলাচল করে এমন সড়কে পথচারীদের ঝুঁকির কথা বিবেচনায় রেখে গতিসীমা সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বাধ্যতামূলক করেছে। আমাদের দেশে এখন এটা প্রতিটি শহর ও শহরতলিসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বাধ্যতামূলক করার সময় এসেছে। কারণ মানুষের নিরাপত্তা সবার আগে। সড়ককে অবশ্যই পরিণত করতে হবে মানুষের নিরাপদ চলাচলের জন্য, জীবনের জন্য, প্রাণ রক্ষার জন্য। তা না হয়ে গতির উন্মাদনায় যদি আমরা সড়কে প্রাণকেই প্রতিনিয়ত বিসর্জন দিতে বাধ্য হই, তাহলে আর কীসের রাষ্ট্র, কীসের আইন, কীসের সড়ক?

 

আরবি/জেআই

Link copied!