ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪

কৃষি প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহারেই উন্নতি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৪, ১০:৩৯ এএম

কৃষি প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহারেই উন্নতি

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

পরিবেশগত রূপান্তর আর বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে গেলে সবার আগে খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। দিনের পর দিন মানুষের জন্য বসতি নির্মাণ করতে গিয়ে যেভাবে জমির পরিমাণ কমছে তেমনিভাবে পরিবেশ বিপর্যয় কেড়ে নিচ্ছে জমির উর্বরাশক্তি। তাই মৃত্তিকা গবেষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রায়োগিক সফলতার মধ্য দিয়ে খাদ্য উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এই বিষয়ে বহু আগে থেকেই কাজ শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের গৃহীত উদ্যোগও নেহায়েত ঠুনকো নয়।

আমরা জানি যে, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। আর কৃষির টেকসই উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক ও সময়োপযোগী ব্যবহারের ওপর। বাংলাদেশে কৃষির উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবর্তনশীল কৃষি উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, ভোক্তা অধিকার, কৃষি আবহাওয়া, জলবায়ু পূর্বাভাস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষত, কোন মৌসুমে কোন ফসল চাষ করা যেতে পারে; তার উৎপাদন কেমন হবে; কবে তা কেটে ঘরে তুলতে হবে; এই সকল ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত ধারণার উৎকর্ষ না থাকলে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় কৃষককে। আর সেক্ষেত্রে একটি দেশকে উন্নততর করতে হলে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ প্রয়োজন। আজ আমাদের অনেক সম্পদ রয়েছে; যেমন উর্বর মাটি আছে, বিশাল সমুদ্র ভাণ্ডার আছে, সস্তা শ্রম আছে। নেই শুধু টেকনোলজি বা প্রযুক্তির পর্যাপ্ত নিশ্চয়তা। এই সম্পদগুলোকে যথাযথ ব্যবহারের জন্য দরকার সঠিক প্রযুক্তি ও এর অর্থবহ ব্যবহার।

আমরা যদি কৃষিকে লাভজনক করতে চাই, তাহলে আমাদের আধুনিক প্রযুক্তি যেমন জিএমও, জিন এডিটিংয়ের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া ফসলের রোগ, ফসলের জাতভিত্তিক পুষ্টি নির্ণয়, পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ে নতুন প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া। এক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ও প্রসারের ভূমিকা অনেক বেশি। উদ্ভাবিত সকল প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে লাগসই প্রযুক্তিসমূহ নির্বাচন করে কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীদের নিকট পৌঁছে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

প্রতিদিন কৃষিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন উদ্ভাবন। কিন্তু এসব প্রযুক্তির উদ্ভাবন যথাযথভাবে ও সঠিক সময়ে কৃষকের নিকট পৌঁছাতে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গবেষণার ফলাফল জার্নাল বা পাবলিকেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। কিন্তু গবেষকদের অর্জনগুলো তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলে তার থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ ছিল সবার। আর তাতে করে একদিকে দেশ যেমন কৃষি ক্ষেত্রে উন্নত হতো, পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও তা সহায়ক হতে পারত।

দার্শনিক রুশো যখন বলেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবান্বিত শিল্প হচ্ছে কৃষি তার বাস্তবতা যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক কৃষিকাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশের শতকরা ৪০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিশ^ব্যাংকের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, কোনো দেশে যদি দশ শতাংশ মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ে তাহলে এক শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কোন সময়ে কী চাষ করা দরকার, বীজের গুণাগুণ, মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সার প্রয়োগের সঠিক মাত্রা, বালাই প্রতিকারের উপায়, উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যবাজার দর ইত্যাদি কৃষকদের দৈনন্দিন তথ্যের চাহিদা দ্রুততার সঙ্গে পূরণ করা সম্ভব। অন্তত টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে গেলে পদ্ধতিগত দিক থেকে এই ধারণা বাস্তবায়নের বাইরে তেমন কোনো নিরাপদ বিকল্প খুঁজে বের করা কঠিন। বিশেষ করে, কৃষিতে আধুনিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ অনিবার্য। কারণ, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় খাদ্য চাহিদা মেটাতে পুরোনো প্রযুক্তি দিয়ে কৃষিকে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করতে গেলে অন্তত উৎপাদনের স্বল্পতায় আমাদের বারংবার পিছিয়ে পড়তে হবে।

আমাদের খরাঞ্চল, বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর অঞ্চল এবং লবণাক্ত অঞ্চলের জন্য নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনের পাশাপাশি উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেমন- উচ্চমূল্য ফসল, শাক-সবজি, ফুল, ফল ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি বাজারের সঙ্গে এদের সংযোগ ঘটাতে হবে। সেজন্য পরিবহন ব্যবস্থা ও অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় হিমাগার স্থাপন করতে হবে। এক কথায় উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সর্বস্তরে যান্ত্রিকীকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সময়ের দাবি।

অনেকেই প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন। প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কম্পিউটার থাকতে হবে, বা প্রত্যেক নাগরিকের হাতে ল্যাপটপ থাকতে হবে। এর মূল কথা হলো, যত দ্রুত সম্ভব জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া। অন্যভাবে যদি আমরা বলি, জনগণ সেবার কাছে আসবে না বরং সেবাই যাবে জনগণের কাছে। মানুষ যাতে কম সময়ে কম খরচে এবং সহজে সব প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা পায় এবং তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যসেবা গ্রহণ করতে পারে এটাই মূল লক্ষ্য। কারণ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে কৃষি প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহারই পারে মানসম্মত জনজীবন নিশ্চিত করতে।

কৃষি প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহার সাম্প্রতিক বাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কৃষি প্রযুক্তি কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি, মান উন্নয়ন এবং কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই কৃষি প্রযুক্তির টেকসই ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি যা সময়, স্থান ও পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে তুলনা করে নির্ধারণ করা যেতে পারে। যদি প্রশ্ন করা হয় টেকসই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার কেন গুরুত্বপূর্ণ? সেক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হবে পরিবেশ সুরক্ষার কথা। টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা সহজেই মাটির উর্বরতা রক্ষা করতে পারি। পাশাপাশি প্রতিরোধ করতে পারি পানিদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে। অন্যদিকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতেও টেকসই প্রযুক্তি সাহায্য করতে পারে।

জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে কৃষি প্রযুক্তির বিকল্প নেই। বিশেষত,  দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৃষি উৎপাদন কৃষকদের আয় বাড়াতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে উপযুক্ত পদ্ধতিতে তৈরি জৈব সার, জৈব কীটনাশক: পরিবেশবান্ধব সেচ ব্যবস্থা, সৌরশক্তি ব্যবহার করে পাম্প চালানো, কীটপতঙ্গ দমনে প্রাকৃতিক পদ্ধতির ব্যবহারের পাশাপাশি উন্নত আবর্জনা ব্যবস্থাপনা কৃষিকে নতুন মাত্রা এনে দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সুবিধা হিসেবে পদ্ধতি এবং যান্ত্রিক ব্যবহার দুটোকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আর সেটা সম্ভব হলে টেকসই কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনৈতিকভাবে যেমন সফল হওয়া যাবে; তেমনি পরিবেশ সংরক্ষণেও কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।  

 

Link copied!