‘‘ধনতান্ত্রিক সমাজ এমন একটা সভ্যতা যা মানুষের সমস্ত অনুভূতিকে পণ্যে পরিণত করে, সুকুমার বৃত্তিকে পণ্যে পরিণত করে। এর চেয়ে হৃদয়হীন, এর চেয়ে নির্দয়, এর চেয়ে নির্মম সভ্যতা ইতিহাসে আর সৃষ্টি হয়নি। এ সভ্যতা মানুষের প্রেম, ভালোবাসা, তার মায়া মমতা, প্রীতি, বন্ধুত্ব, যা কিছু সুন্দর, সুকুমারকে পঙ্গু করে দেয়, তাকে শুষ্ক করে দেয়, পণ্যে পরিণত করে।’’ বর্তমান গতিশীল বিশে^র প্রকৃতিতে কার্ল মার্কসের এই উক্তিটি যথার্থতার দাবি রাখে।
‘অর্থই অনর্থের মূল’- এ কথা যেমন সত্য তার চেয়েও বাস্তবতা হলো অর্থ ছাড়া আপনি এই পৃথিবীর কিছুই না। আপনার মাপকাঠি হলো অর্থ। আপনার সম্মান এবং সামাজিক মর্যাদা ঠিক করে অর্থ। আপনি জীবন যাপন কীভাবে করবেন তার মাপকাঠি অর্থ। অর্থাৎ পৃথিবী দুইভাগে বিভক্ত করেছে এই অর্থ। অর্থের প্রয়োজন মানুষের সবসময়ই ছিল। একসময় বিনিময়প্রথা ছিল। তারপর যখন মুদ্রার প্রচলন হলো তখন এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ তীব্র হতে থাকে মূলত এর ক্ষমতার ওপর। কারণ মানুষের ক্ষমতা নির্ভর করে অর্থে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা যেদিকে অগ্রসর হচ্ছে সেখানে অর্থই মাপকাঠি। বিশ্বে যেমন একদিকে দারিদ্র্য, খাদ্য সংকট প্রভৃতি বিরাজ করছে বিপরীত চিত্রও রয়েছে। এর বিপরীতে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রচুর খাদ্য নষ্ট হচ্ছে। এই সংখ্যা কত কম না বেশি তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্রমেই এই সংখ্যা বাড়ছে। অর্থাৎ কোটি কোটি টাকার মালিক বাড়ছে। এর ফলে যা হচ্ছে তা হলো সমাজ একটি নিশ্চিত বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
একটু বাস্তবতার কথা বললে, বাজারে যখন একটি মাছ তিন-চার বা তার কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়, একজন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত কারও তা এক টুকরো স্বাদ নেওয়ার ক্ষমতা থাকে না, কারণ একসঙ্গে ওই মাছ কেনার সামর্থ্য তার নেই। কিন্তু সেই মাছটি কিন্তু একজনই কিনে নিচ্ছে। বাজারব্যবস্থা এভাবেই চলছে। যার সামর্থ্য আছে সে কিনছে। আর যার সামর্থ্য নেই তারা শুধু দেখছে। এই আফসোস, অতৃপ্তি ভরা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমেই এটি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর কারণে একটি বড় অংশ চাহিদামতো ভোগ থেকে দূরে থাকছে। বৈষম্য তৈরি হয়েছে মানুষে সঙ্গে মানুষের।
এক সময় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেগবান হলেও পুঁজিবাদ মানসিকতার কারণে তা সফল হয়নি। ধনী অতি ধনীর কাতারে পৌঁছে যাচ্ছে এবং দরিদ্র বাড়ছে পৃথিবীজুড়েই। পৃথিবী চলে যাচ্ছে বৈষম্যের দিকে। এর মধ্যেই করোনার উৎপত্তি আমরা দেখেছি। করোনার কারণে প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে ব্যাপকহারে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান বোঝা গেছে ওই সময়। যার সম্পদ আছে তার আরও সম্পদ হচ্ছে আর যার নেই তার শূন্য হচ্ছে। করোনা মহামারি এবং তার পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্বে উচ্চ মূল্যস্ফিতী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনের তথ্যে জানানো হয়েছে, এমন বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতির মধ্যেও আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বে মিলিয়নারের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বাড়বে। ক্রেডিট সুইস গ্রুপ এজি-এর গ্লোবাল ওয়েলত রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৭৫ লাখের বেশি লোক কমপক্ষে ১০ লাখ ডলারের মালিক হবে, যা ২০২১ সালের ছয় কোটি ২৫ লাখ মিলিয়নিয়ার থেকে বেশি। পূর্বাভাসটিতে বলা হয়েছে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়বে। আবার চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিশ্বের ৫০০ ধনী এক দশমিক চার ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ হারিয়েছে। এভাবেই পৃথিবীতে আয় বৈষম্য ব্যাপকভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে।
একটি ধনতান্ত্রিকতা তৈরি হচ্ছে যেখানে অর্থই সব ব্যবস্থার চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। সবচেয়ে বেড়েছে অতি দরিদ্র। অপরদিকে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যাও। সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ জন। সেখান থেকে প্রতি বছর কোটিপতির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অবস্থা এমন যে সমাজে মারাত্মক শ্রেণিবিভাজন তৈরি করছে এই কোটিপতি বৃদ্ধি। বলাইবাহুল্য যে, এখানে দুর্নীতিবাজ মানুষের একটি বড় অংশই রয়েছে।
১৯৭৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৭ জন। আর ১৯৭২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৩৬ বছরে দেশে কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে ১৯ হাজার ১৫৮ জন। ২০০৮ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত তা ৭৪ হাজার ১২৭ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০ জন। অর্থাৎ এই কয়েক বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে লফিয়ে লাফিয়ে। করোনা মহামারি বহু মানুষকে দরিদ্র পর্যায়ে নামিয়ে দিলেও ধনীদের সম্পদ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন কোটিপতি তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন করে দরিদ্রের কাতারে নাম লেখাচ্ছে অনেকেই। এই বিপরীত চিত্রই পৃথিবীকে একটি বৈষম্যপূর্ণ পৃথিবীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকহারে। আবার এক শ্রেণির পকেটে টাকা থাকায় এখানেও বৈষম্য বিরাজ করছে। কেউ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতেই মাসের আয়ের বেশিরভাগ অংশ খরচ করছেন।
যেখানে পুঁজিবাদের নির্যাস থাকে। বহু বছর ধরেই পৃথিবী পুঁজিবাদের রস নিঃসরণ করে চলছে। মানুষ কাজের খোঁজে ছুটছে কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সংকট রয়েছে। যদিও পৃথিবীর অর্থনীতির গতি সামগ্রিকভাবে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে তা থেকে পৃথিবীকে নিষ্কৃতি দেওয়া প্রয়োজন। যখন মানুষের আয় ব্যবধান বাড়তে থাকে তখন সমাজে নানা ক্ষেত্রে অস্থিরতা দেখা দেয়। অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অর্থনীতির গতি ফেরাতে কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। একটি বৈষম্যমূলক পৃথিবীতে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা কষ্টকর হয় এবং তা সম্ভব হয় না। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে এবং সেখানে অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে। আগামী বছর অর্থনীতিতে যে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে তা হলে পৃথিবীজুড়েই দরিদ্রতার হার বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে পৃথিবী যে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছিল সে অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। অথচ আমাদের প্রয়োজন একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী এবং বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা।
বর্তমান শ্রেণি কাঠামোতে পুঁজিবাদ ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। সমাজ সমতাতান্ত্রিক যে আন্দোলন বা চেতনা তা ক্রমশই মার খেয়েছে। যুদ্ধ বিগ্রহ হানাহানিতে অস্ত্রের ব্যবসা জোরদার হয়েছে। এই অস্ত্রই মানুষের জীবন কাড়ছে। মানুষকে অনাহারে রাখছে আবার মানুষকে ঘরছাড়াও করছে। ঠিক এর বিপরীতে এক শ্রেণির মানুষ শত শত তলার বিল্ডিং তুলছে। আরাম আয়েশে বড় হচ্ছে। বিলাসিতায় জীবন কাটাচ্ছে। পুঁজিবাদ সমাজ এবং পৃথিবীটাকে গ্রাস করছে। এই নিয়মিত প্রথা ভেঙে ঠিক কীভাবে একটি সমতাতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা যায় সে পথের কোনো দিশা নেই। কারণ ভোগসর্বস্ব সমাজে এটা অসম্ভব। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে সমাজে এই ভোগ প্রবণতা যেন হ্রাস পায় বা অবৈধ ভোগের সুযোগ কমে আসে তার লাগাম টেনে ধরা।
আপনার মতামত লিখুন :