দেশের মানুষ হাসিনার একনায়কতন্ত্র থেকে মুক্তি চেয়েছিল একটা সার্বিক পরিবর্তনের জন্য। নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের। স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন, সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাও ছিল। কিন্তু সরকার গঠনের তিন মাস পরেও এসব বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় অনেকের মধ্যে হতাশা দেখা যাচ্ছে।
একটা অভাবনীয় ছাত্রগণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গত দেড় দশক ধরে এক অপ্রতিহত ক্ষমতা ও শক্তির শাসন কায়েম করেছিল। বিরোধী দল, বিরোধী মতকে শক্তি দিয়ে দমন করে নিজেদের অবিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ছাত্রদের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সেই ‘লৌহশাসন’ তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে।
ওই হতাশার পর অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, এটি অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা, ১৬ বছরের অচলায়তন দুই মাসেই ভাঙবে কীভাবে? এ জন্য সময় দিতে হবে। সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। এ কথা ঠিক যে, সরকারকে সময় দিতে হবে। পরিবর্তন রাতারাতি হবে না। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক যে, পরিবর্তনের রাস্তায় যাত্রাটা তো ঠিকঠাকমতো শুরু করতে হবে। তা কি হয়েছে? দীর্ঘ দুই মাসেও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। পুলিশকে সক্রিয় করা যায়নি। সামরিক বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান পরিবর্তন নেই। খুন, ছিনতাই, রাহাজানি-চাঁদাবাজি হচ্ছে বল্গাহীনভাবে। গণপিটুনি বা মব ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছেন অনেক নিরীহ মানুষ। ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ এই অভিযোগ এনে ঢালাওভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। বাছবিচারহীনভাবে হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দিদের আদালতে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা ক্ষমতাসীনদের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করলেই একটা শ্রেণি হৈহৈ করে তেড়ে আসছেন। ভিন্নমত বা সমালোচনা করলেই মব-ভায়োলেন্স বা মব লিঞ্চিংয়ের শিকার হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো সেই পুরোনো পথেই হাঁটার লক্ষণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো বেতাল হয়ে দিন পার করছে। কবে তাল খুঁজে পাবেন তা কেউ বলতে পারছেন না।
এদিকে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের’ পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর ভর করে ‘বিএনপি-জামায়াতের ফ্যাসিবাদ’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আইন ও বিচারালয়, সবখানে ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত করতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতের হাতে ন্যস্ত হয়েছে যেন। বর্তমানে গণমাধ্যমগুলো কেমন যেন একচাখো হয়ে গেছে। অনেক কিছু তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। আওয়ামী লীগ আমলের মতো একটা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ যেন চেপে বসেছে। এটা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। আমাদের দেশে বিরোধিতা বা সমালোচনাকে সহ্য করা হয় না। আমরা চাই কেবল সমর্থন, প্রশংসা আর আনুগত্য। সমালোচনা তা যত গঠনমূলক হোক না কেন, সেটা আমরা মানতে বা সহ্য করতে পারি না। ফলে আমাদের দেশে ‘সমালোচক’ তৈরি হয় না, তৈরি হয় স্তাবক আর শত্রু বা বিদ্বেষকারী। এই মনোভাবের কারণে বিরোধী দল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। অবশ্য বিরোধী দলও আমাদের দেশে কেন জানি গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে কেবলই হিংস্রতা প্রদর্শন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, ‘ধ্বংস হোক নিপাত যাক’ টাইপের ধারণা পোষণ করে। ফলে আমাদের দেশে দুটি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে পরিণত হয় ঘোরতর শত্রুতে।
এখানে বিরোধী দলকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। অনেক সময় বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেও বাধা দেওয়া হয়। বিরোধীদের ঘায়েল করতে মিথ্যে মামলায় জর্জরিত করে রাখা হয়। এতসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বিরোধী দল তাই খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। অথচ গণতন্ত্রের চর্চায় বিরোধী দল থাকা অপরিহার্য। শুধু গণতন্ত্রের খাতিরেই নয়, যে কোনো বিবেচনাতেই বিরোধী দল বা সমালোচক প্রয়োজন। কেননা একজন ব্যক্তি বা একটি দল সব সময় সব সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নিতে পারে না। তার সেই সিদ্ধান্ত ভুল না ঠিক, কোথায় গলদ, কোথায় সমস্যাÑ এগুলো আরেকজনের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। বাইরের কেউ যদি একটা উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়, ভিন্ন কোনো ভালো পথের সন্ধান দেয়, আখেরে সেটা সবার জন্যই লাভ। সে জন্যই ইংরেজিতে বলা হয় ঈৎরঃরপং অৎব ণড়ঁৎ ইবংঃ ঋৎরবহফং অর্থাৎ সমালোচক হচ্ছেন আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু।
কিন্তু আমরা সবাই ‘সবজান্তা শমশের’ হয়ে বসে আছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের মত ও পথ সেরা বলে ধরে নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে অটুট থাকি। তাই সমালোচনা ও বিরোধিতাকে শত্রুতা হিসেবে ধরে নিই। সবার চোখ ও জবান বন্ধ করে দিয়ে কেবল নিজেরটাকে শ্রেয় মনে করে পথ চলি। তাই আমাদের দেশে বিরোধী দল কখনো শক্তিশালী হয় না। বিরোধীদের কণ্ঠস্বর কখনো উচ্চকিত হতে পারে না। বিরোধী মত বিকশিত হওয়া খুব, খুবই প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়ে ১৯৮৯ সালে সুমন একটা গান লিখেছিলেন, ‘বিরোধীকে বলতে দাও’। বিরোধীর নিজের কথা নিজের মতো করে বলার স্বাধীনতা কতটা জরুরি, ইতিহাস সেটা বার বার প্রমাণ করেছে। নানা দেশে, নানা পরিস্থিতিতে। যেমন- এই মুহূর্তে বাংলাদেশে। অতীতে যারা সরকারে ছিলেন তাদের অনুসরণ করে এখনো অনেকে বিরোধী মত শুনলে জ¦লে ওঠেন। যে কোনো বিষয়ে বিপরীত কথা শুনলেই ক্রোধ জেগে ওঠা, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা এক ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় অসুখ।
বিরোধীকে বলতে না দেওয়ার স্বভাব আমাদের দেশে অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত। যারা রাষ্ট্রক্ষমতার বিরোধিতায় সরব ও সক্রিয়, তারাও সচরাচর ভিন্নমত শুনতে আগ্রহী নন। এ কারণেই ‘বিরোধীকে বলতে দাও’ গানটির কথা আবার মনে পড়ল। সুমনের জবানিতে জানা যায়, পোলিশ মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, সমাজ দার্শনিক ও বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গকে স্মরণ করে তিনি বেঁধেছিলেন এই গান। রোজা লুক্সেমবার্গ পোল্যান্ড থেকে জার্মানিতে যান এবং সেখানকার নাগরিকত্ব অর্জন করে বামপন্থি আন্দোলনের বিকল্প পথ সন্ধান করতে গিয়ে, সেই বিকল্প পথে বামপন্থি আন্দোলন গড়ে, নিজেদের বামপন্থি বলে অভিহিত করা ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের হাতেই ১৯১৯ সালের জার্মানিতে নিহত হয়েছিলেন রোজা লুক্সেমবার্গ। এই কারণেই সুমনের গানটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। লুক্সেমবার্গের মৃত্যু দেখিয়ে দেয়- প্রতিবাদের রাজনীতিতে সওয়ার হয়ে যারা ক্ষমতায় আসে, তারাও প্রতিবাদী স্বরকে দমন করতে চায়, বিরোধীকে বলতে দেওয়ার স্বাধীনতা তারাও দিতে রাজি নয়। এই ব্যাধি কেবল ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ রাজনীতির নয়।
আমাদের দেশের উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তারা বৃহত্তর জনসমাজের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের সঙ্গে সমাজের মানুষের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না, নিজেদের জীবন ও ভাবনার সঙ্গে সেই কেতাবি ধর্মনিরপেক্ষতা বা উদার গণতন্ত্রের বুলিকে মেলাতে পারেন না। এই দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা নিশ্চয়ই করা দরকার।
কিন্তু সমস্যাটা নিছক দূরত্বের নয়। সমস্যা ভিন্নমত না-শোনারও। আমরা, যারা উদার গণতন্ত্রের কথা বলি, তারাও ভিন্নমত মন দিয়ে শুনতে রাজি নই। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে যারা প্রশ্ন করেন, তাদের সঙ্গে আলোচনায় আমরা নারাজ। অথচ মনে রাখতে হবে, ধর্ম এবং রাজনীতিকে পরস্পর থেকে দূরে রাখার যে পশ্চিমা ধারণা আমাদের নাগরিক সমাজে স্বীকৃত হয়েছে, কিংবা সমস্ত ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের সমভাব পোষণের যে নীতি আমাদের দেশে গৃহীত হয়েছে, তার বাইরেও ধর্ম বিষয়ে, ধর্ম ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে নানা মত থাকতে পারে। সেই মত আমরা মানি বা না মানি, তার সঙ্গে আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত, আমাদের জনজীবন এবং চিরাচরিত রাজনীতির পরিসরে ধর্মের খুব বড় ভূমিকা ছিল এবং আছে। তাকে বাদ দিয়ে চলতে গেলে সমাজের বিরাট অংশকে বাদ দিয়ে চলতে হয়। সেটা গণতন্ত্রের স্বধর্মের বিরোধী। এই ধর্মচ্যুতিই আমাদের ক্ষতি করেছে, ক্ষতি করে চলেছে। আর তার ফসল তুলছে ধর্মবাদী রাজনীতির কারবারিরা।
এই ধারার যদি দ্রুত অবসান না হয়, পরিবর্তন না হয়, তাহলে তা না হলে রাজনীতিতে আবর্তন হবে হয়তো, কিন্তু পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না!
আপনার মতামত লিখুন :