সর্বশেষ তথ্যমতে, পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর ছিল ২০২৩ সাল। বছরটি উষ্ণতার দিক থেকে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এতে বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস সত্য প্রমাণ করে নিশ্চিত হওয়া গেল ২০২৩ ছিল এই গ্রহের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, পৃথিবীর এই অবস্থা মানুষেরই সৃষ্টি। এই গ্রহ গরম হয়ে ওঠার পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহারই দায়ী। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয়, দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে আমাদের শরিক হওয়া প্রয়োজন তা না-হলে বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির আওতায় আছি। মাঝে মধ্যে এর ভয়াবহ বিরূপ প্রভাবও অসহায়ের মতো সহ্য করতে হয়। প্রশ্ন, কেন এই অবস্থার সৃষ্টি? উত্তর হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। গত এক দশক ধরে আমাদের এই পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তারপরও এ নিয়ে কোনো উদ্বিগ্ন নই আমরা। দিব্যি আছি। অথচ এই মহাদুর্যোগ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় আমরা এখনো খুঁজে বের করিনি। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্লাইমেট সার্ভিসের তথ্যমতে, জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহার শুরুর দীর্ঘ সময়ের গড়-উষ্ণতা বাড়ার তুলনায় গত বছর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি। ২০২৩-এর জুলাই থেকে প্রতি দিনই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়। ভয় এখানেই। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের লক্ষ্যমাত্রা সত্যিই ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে জরুরি দরকার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের রাশ শক্ত হাতে টেনে ধরা। সমস্যাটি যেহেতু বৈশ্বিক, তাই প্রতিকারের উপায়টি খুঁজে বের করার দায়িত্বও বিশ্ববাসীর। কিন্তু সেই কাজ করা সম্ভবপর হয়নি বলে গত বছরটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উষ্ণতম বছরে পরিণত হয়। এটা বিশ্ববাসীর জন্য ছিল আসলেই দুশ্চিন্তার কারণ। ২০২৩ সালের মাসগুলো পার হয় একের পর এক উষ্ণতম মাস হিসাবে রেকর্ড সৃষ্টি করে। এর মধ্যে অক্টোবরের তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি বিশ্বের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করা উষ্ণতম মাস। ২০২৩-এর নভেম্বরেও তার আগের বছরের নভেম্বরের উষ্ণতার চেয়ে বেশি উষ্ণতম মাস হিসাবে রেকর্ড গড়ে। গত বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছিল শিল্পায়ন যুগের আগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি, এক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় নতুন রেকর্ড।
ইউরোপভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, শিল্পপূর্ব অক্টোবরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর ছিল অনেক বেশি উষ্ণ। এর তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কোপারনিকাস সার্ভিসের উপ-প্রধান সামান্তা বারগেসের মতে, ২০২৩ সালের ছয়টি মাস এবং দুটি মৌসুম উষ্ণতার বেলায় নতুন রেকর্ড গড়ে। তাই ২০২৩ সাল হলো স্মরণকালের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জোরদার হয় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রেখে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার দাবি।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, জীবাশ্ম জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে এই বিশ্ব এখনো দ্বিধাবিভক্তি। একদিকে তেল উৎপাদনকারী দেশসমূহের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা করার তীব্র আকাক্সক্ষা আর একদিকে ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোট অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড (এওএসআইএস)-এর জলবায়ুর ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকার লড়াই- এই বৈশাদৃশ্যের লক্ষণ কপ-২৮ সম্মেলনের শেষ দিকেও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ঘড়ির কাঁটা ধরে ঝুলতে থাকা এই বিভেদ রীতিমতো বড় হয়ে উঠেছিল। নানামুখী চাপ ছিল ঠিকই, তারপরও জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের শেষদিকে বিষয়টি অমীমাংসিত থাকতে দেখা যায়। কারণ, কয়েকটি দেশ প্রকাশ্যেই চেয়েছিল, কপ-২৮-এর আলোচনায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করা না-করা নয়, দূষণ কমিয়ে আনার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে। এ ব্যাপারে বেশি সরব ছিল জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী ও রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব ও রাশিয়া। জ্বালানি তেলের রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক সম্মেলনের ঠিক আগের সপ্তাহে সদস্য দেশ ও ওপেক প্লাস জোটের দেশগুলোকে চিঠিও দিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, কপ-২৮ সম্মেলনের চুক্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে কোনো কিছু উল্লেখ থাকলে তা যেন প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ অবস্থায় স্বভাবতই ধারণা করা হয়েছিল, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হবে না! ওপেক ধোঁয়াশা তৈরি করে তাদের দ্বৈত চেহারাটাই সবার চোখের সামনে পরিষ্কার করে তুলেছিল। দূষণ কমানোর কথা তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছিল বটে, কিন্তু জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ¦ালানি যে বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে, এ নিয়ে তারা মুখে রা-শব্দটিও করেনি।
ওপেকের পক্ষ থেকে এমন চিঠি দেওয়ার নজির আগে কখনো ঘটেনি। এর মধ্যদিয়ে সংস্থাটি প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় প্রভাব রাখার চেষ্টা করে। তার ওপর, ওপেকের সদস্যদেশ সৌদি আরব আর ওপেক প্লাস জোটের সদস্য রাশিয়া জ্বালানি তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সারা বিশ্বই এটা জানে।
এমন একটা বিরূপ অবস্থা জিইয়ে থাকার পরও ২৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন কপ (কনফারেন্স অব পার্টিস) ২৮-এর সদস্য দেশগুলো (২০০টি দেশ) একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে তারা পর্যায়ক্রমে সরে আসবে। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ুর চুক্তির পর দুবাই জলবায়ু চুক্তিটিও ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
জাতিসংঘের মতে, ২০১৫ সালের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হলো জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮। তাই জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহার রোধ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিশ্ববাসীকে বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানি জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
সুখবর হলো, মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমান নবায়নযোগ্য জ¦ালানি সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদনের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। গ্রিন হাইড্রোজেন বা সবুজ হাইড্রোজেন প্রযুক্তিতে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি হিসেবে জলবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। এসব উৎস থেকে বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে যে-হাইড্রোজেন পাওয়া যায় তা পরবর্তী সময়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আধুনিক এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে কার্বন নিঃসরণ কমে আসবে। তাই এ প্রযুক্তিতে বড় রকম বিনিয়োগ করে সৌদি আরব। লোহিত সাগর পাড়ে ৮৪০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাইড্রোজেন কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা। ২০২৬ সাল নাগাদ এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ৬০০ টন হাইড্রোজেন পাওয়া যাবে। নতুন এই হাইড্রোজেন কেন্দ্রের সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এ বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করেই উৎপাদন করা হবে সবুজ হাইড্রোজেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতও ২০৩১ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হাইড্রোজেন উৎপাদনকারী ১০ দেশের তালিকায় তার স্থান নিশ্চিত করতে চাইছে। আর ওমান তো এদিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। ২০২৩ সাল থেকেই তারা নবায়নযোগ্য জ¦ালানির প্রকল্প নিয়ে পথচলা শুরু করে। ১০ লাখ টন হাইড্রোজেন উৎপাদন করার কার্যক্রম হাতে নিয়ে এগোচ্ছে তারা আর ২০৫০ সালের মধ্যে তাদের লক্ষ্য ৮৫ লাখ টন সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন করা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ উন্নত বিশ্ব যেখানে বিকল্প পথে সবুজ হাইড্রোজেন প্রযুক্তি অভিমুখে এগিয়ে গেছে সেখানে আমরা হাত-পা গুটিয়ে নিশ্চুুপ বসে আছি। যেন কিছুই ঘটেনি এমন একটা ভাব নিয়ে আছি নিশ্চিন্তে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াবার লক্ষ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসবার কোনো উপায় আমরা এখনো খুঁজে বের করিনি। এই অলসতা কিছুতেই কাম্য নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে আমাদের এখনই খুঁজে নিতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথ। হাতে সময় খুব কম। বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী নিশ্চিত করার সুযোগ যাতে সঙ্কুচিত না-হয়ে পড়ে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটুকু আন্তরিক, আমরা জানি না।
আপনার মতামত লিখুন :