ঢাকা বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

মিলনের রক্তধারা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ১১:৪৩ এএম

মিলনের রক্তধারা

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পুরো দেশ তোলপাড়। দেশব্যাপী চলছিল রাজপথ-রেলপথ অবরোধ। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) একটি জরুরি সভা হবে। সে সভায় যোগ দেওয়ার জন্য আজিমপুরের বাসা থেকে সকাল দশটার দিকে রিকশায় করে যাচ্ছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম মহাসচিব ডা. শামসুল আলম খান মিলন। টিএসসির মোড়ে আসতেই ডা. মিলনকে ডাক দিলেন আরেক রিকশায় থাকা বিএমএ মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ডা. জালাল বললেন, মিলন আমার রিকশায় চলে এস, এক সঙ্গে যাই।
রিকশা ছেড়ে দিয়ে ডা. জালালের রিকশায় চড়ে বসলেন ডা. মিলন। কিন্তু কে জানত, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওঁৎপেতে ছিল আততায়ীরা! রিকশা কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ ডা. মিলন বললেন, জালাল ভাই, দেখেন তো আমার কী হয়েছে?

ডা. মিলনের দিকে তাকিয়ে তাজ্জব হয়ে গেলেন ডা. জালাল। গুলির শব্দ তিনি পেয়েছেন, কিন্তু সেটা যে তার রিকশার সহযাত্রী ও সহকর্মীকে বিদ্ধ করেছে, টের পাননি। টের পেলেন রক্তে ভেসে যাওয়া মিলনের গুলিবিদ্ধ শরীরের দিকে তাকিয়ে।

সময় নষ্ট না করে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো মিলনকে। কিন্তু তাকে প্রাণে বাঁচানো যায়নি। এগারোটার আগেই সহকর্মীদের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে শহীদ হলেন মিলন। আর ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেলেন ডা. জালাল। কিন্তু কেন এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো? কেন ডাক্তার মিলনকে টার্গেট করা হলো? কারণ একটাই- ডা. মিলনকে হত্যার মধ্য দিয়ে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারার অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল তখনকার স্বৈরাচার এরশাদ।

ডা. মিলনের জন্ম ১৯৫৭ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায়। ১৯৮৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হন। ১৯৮৮ সালে বায়োকেমিস্ট্রিতে এমফিল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন।

ডা. মিলন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চিন্তাধারায় সিক্ত মানুষ। তাকে নিয়ে নানা জায়গায় স্মৃতিচারণ করেছেন তার মা সেলিনা আক্তার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপ ছিল ডা. মিলনের। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন, যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশ দিলেন, ডা. মিলনও সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। পাড়ার অনেকের সঙ্গে কাঠের বন্দুক নিয়ে প্যারেড করতেন মিলন।

ছাত্র থাকা অবস্থাতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন মিলন।

স্বৈরাচারবিরোধিতার কারণে তাকে রংপুরের রৌমারীতে বদলি করা হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকেও তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকবার। অনেকবার তাকে সরকারি দলে যোগ দেওয়ার লোভ দেখানো হয়। ডা. মিলন ঘৃণার সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তাকে চাকরি থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল একবার। তবু দমানো যায়নি ডা. মিলনকে।

তিনি ছিলেন এরশাদের স্বাস্থ্যনীতির কঠোর সমালোচক। ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর স্বৈরাচারবিরোধী বিক্ষোভে নাজির উদ্দিন জেহাদ নামের এক ছাত্র পুলিশের গুলিতে মারা যান। পুলিশ জেহাদের লাশ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ডা. মিলনের নেতৃত্বে ছাত্র ও চিকিৎসকরা তাদের প্রতিহত করে। আর সেদিনই ডা. মিলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় গঠিত হয় সম্মিলিত সর্বদলীয় ছাত্রজোট। তার অসম্ভব সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দক্ষতায় ঘাবড়ে যায় স্বৈরাচার ও তার দোসররা। ডা. মিলন তাদের টার্গেটে পরিণত হন। আর তারই করুণ পরিণতি ঘটে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর।

স্বৈরাচার এরশাদ চেয়েছিল ডা. মিলন হত্যাকাণ্ডের দোষ ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেবে। এই সুযোগে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর দমন-পীড়ন চালাবে। সে কারণে স্বরাষ্ট্র সচিবকে ডেকে কারফিউ জারির ইচ্ছাও পোষণ করেছিল এরশাদ। কিন্তু এরশাদের পরিকল্পনার সঙ্গে পরবর্তী ঘটনাগুলো একেবারেই মিলল না। বরং ডা. মিলনের মৃত্যুতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠল। কর্মবিরতির ঘোষণা দিলেন ডাক্তাররা। গণপদত্যাগ করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউজ উইক’ মন্তব্য করল- ‘ডা. মিলনের হত্যাকাণ্ড বিদ্যুৎস্পর্শের মতো দাবানল তৈরি করেছিল। এর ফলে অনির্বাচিত সামরিক সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার কুখ্যাত স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের ঘোষণা দেয়।’

ডা. মিলনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত? শুধুই কি স্বৈরাচারী এরশাদ? নাকি পর্দার আড়ালে আরও কিছু রয়ে গেছে?

১৯৯০ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত মাসিক ‘গণসংস্কৃতি’ পত্রিকায় ডা. মিলনের একটি লেখার অংশ বিশেষ থেকে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ডা. মিলন লিখেছিলেন- ‘সরকার মূল সমস্যাসমূহের সমাধানের পথে না গিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরবস্থার জন্য চিকিৎসকদেরও দায়ী করেছেন। অথচ সরকার ২৮ পয়সা বরাদ্দ করে জনগণের কাছে কোন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করতে চায় তা বলছে না। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ও শক্তিশালীভাবে গড়ে তুললে জনগণ কখনো বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হতো না। তাই আজ প্রথম প্রয়োজন সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। অথচ সে পথে না গিয়ে সরকার স্বাস্থ্য বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর ফলে গরিব জনগণ আজ যতটুকু চিকিৎসা পাচ্ছে, তা থেকেও বঞ্চিত হবে। তাই আজ প্রথম প্রয়োজন একটি জনগণের সরকার, যারা জনগণের স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাধান্য দেবে।’

তার মানে ডা. মিলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে সরকারিকরণের মাধ্যমে দেশের আপামর জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করা। সামরিক শাসনের সময় অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমিয়ে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় বাড়ানোর যে চাপ, চিকিৎসক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সে আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। জনমুখী জাতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা আন্দোলনের অগ্রবর্তী সৈনিক ছিলেন মিলন। মোদ্দাকথা, বেসরকারিকরণের মাধ্যমে চিকিৎসার নামে ব্যবসার ঘোর বিরোধী ছিলেন মিলন। আর সেটা পুঁজিপতি স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের স্বার্থে চরম আঘাত করেছে নিশ্চয়ই। যা তার জীবনের জন্য হয়ে উঠল মারাত্মক হুমকি।

এর প্রমাণ মেলে ডা. মিলন শহীদ হওয়ার পর পরবর্তী কর্মকাণ্ডে।

ডা. মিলন নিহত হওয়ার দিন সন্ধ্যায় রমনা থানায় (তখন শাহবাগ থানা হয়নি) একটি মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশি তদন্ত ঘুরতে থাকে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের এ হাত থেকে সে হাতে। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি আদালত চার্জ গঠন করেন। ৩১ জনকে সাক্ষী করে চার্জশিট দেওয়া হয়। কিন্তু আদালত ১৪ জন সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণা করেন। জনশ্রুতি হিসেবে ডা. মিলন হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন ধরা হয় তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ক্যাডার ও তার দলকে। সেই ক্যাডার ছাত্ররাজনীতি করত। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কয়েক মাস আগে গ্রেপ্তার হয়।

নভেম্বরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সেই ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা মিষ্টি-মালা দিয়ে তাকে বরণ করে নেয়। শুধু তাই নয়, সেই ক্যাডারকে সন্তান হিসেবে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন এরশাদপত্নী। বিপুল পরিমাণ উপহারও দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন ভণ্ডুল করার জন্য তাকে কাজে লাগানো হয়। সেটা সে সময়কার ছাত্রনেতারাও বুঝতে পেরেছিলেন। এবং তার প্রমাণও মিলল অনেক বছর পরে।

১৯৯৬ সালে সেই ক্যাডার এরশাদ গঠিত জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে বরিশাল থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিল। এরপর মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় ফেঁসে পলাতক।

১৯৯২ সালে ডা. মিলনের মায়ের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে মিলন হত্যা মামলার পুনঃতদন্ত ও পুনর্বিচারের আবেদনও করা হয়েছিল। কিন্তু তার কোনো ফল জানা যায়নি।

‘মিলনের মুখ’ কবিতায় শামসুর রাহমান লিখেছেন-

“গুলিবিদ্ধ শহর করছে অশ্রুপাত অবিরত,
কেননা মিলন নেই। দিন দুপুরেই নরকের
শিকারি কুকুর তার বুকে বসিয়েছে দাঁত, বড়
নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ।”
“অকস্মাৎ আকাশে কে যেন দিল ঢেলে কালো কালি,
দুপুর সন্ধ্যায় সাজ পরে বিধবার মতো চোখ
মেলে চেয়ে থাকে আর আঁচলে সংগ্রামী স্মৃতি জ¦লে,
মিলনের মুখে বৃষ্টি নয়, বাংলার অশ্রু ঝরে।


(কাব্যগ্রন্থ: খণ্ডিত গৌরব)

 

আরবি/জেআই

Link copied!