দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন কমছে না, বরং বাড়ছে। উপার্জন করা সত্ত্বেও অর্থের ওপর নারীর অধিকার জন্মাচ্ছে না। যে উন্নয়ন, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না, তাহলে সেই উন্নয়ন আমাদের জন্য কী ফল বয়ে আনছে?
স্ত্রীকে মারধর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুরুষদের রেকর্ড অর্জন করার খবরটিকে আমরা উন্নয়নের কোন ক্যাটাগরিতে ফেলব? এটা কি পুরুষের আধিপত্যবাদী আচরণের নগ্ন প্রকাশ? নাকি সার্বিক মূল্যবোধের আরও অবক্ষয়?
একদিকে উন্নয়নের তুলনা চলছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে, অপরদিকে নারী নির্যাতনে প্রতিযোগিতা করছি পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সঙ্গে। যেসব উন্নত দেশের সমান হওয়ার স্বপ্ন আমরা দেখছি, সেরকম ৩০টি দেশে সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৪ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় ৪র্থ স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি দেখে একটুও বিস্মিত হইনি। কারণ সমাজের চারদিকে চোখ মেললেই দেখতে পাই নারীকে এদেশে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। ঘরের বউকে মনে করা হয় নিজের সম্পত্তি। আর নিজের সম্পত্তি ইচ্ছামতো ব্যবহারের স্বাধীনতা (?) তো রয়েছেই! তাই বউ বা সঙ্গীকে মারতে মারতে বিশ্বে রেকর্ড করে ফেললেও, বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ মনে করে তারা কোনো অন্যায় করেনি এবং তার এজন্য লজ্জিতও নয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জাতীয়ভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দিবস পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী নাগরিক সমাজের গৃহীত নানা ধরনের উদ্যোগের মাধ্যেমে ২০৩০ সালের মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি প্রচারাভিযান শুরু হয় ২০০৮ সালে।
জাতিসংঘের এই প্রচারাভিযান একটি বহুপক্ষীয় উদ্যোগ যা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও তা দূর করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে, অ্যাডভোকেসি প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে এবং আলোচনার মাধ্যমে যথাযোগ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সমাধানে পৌঁছার একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া নির্দেশ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জন নারী তার নিকটতম সঙ্গী বা অন্য কেউ কিংবা উভয়ের দ্বারা নিজের জীবদ্দশায় অন্তত একবার শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন।
এই পরিসংখ্যান থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দেশে দেশে বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণীত হলেও নির্যাতনের সংখ্যায় খুব একটা হেরফের হয়নি। যদিও এই সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব কোভিড-১৯ মহামারির আগের।
এবার যদি আমাদের দেশের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি নিপীড়ন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে নারী ও পুরুষকে দীর্ঘ একটা সময় একই ছাদের নিচে থাকতে গিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা বাড়ার পরিবর্তে বরং কমেছে। অর্থনৈতিক দুর্দশায় যৌতুকের দাবিতে কিংবা কলহের জেরেও নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনাকালে ২০২০ সালে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৬শ’ ৮৭ জন নারী। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ২শ’ ১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে । এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ ২শ’ ২৩টি।
নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের জন্য সরকারি উদ্যোগে গঠিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ৮ হাজার ৪শ’ ১৫ নারী ও শিশু সেবা গ্রহণ করেছে।
পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ধর্ষণ বহুগুণে বেড়ে গেছে। বিচারহীনতা, রাজনৈতিক প্রশ্রয়, ধর্ষণের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ব্লেইমিং (ভুক্তভোগীকেই উল্টো দোষারোপ করা) যৌন সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অনেকেই মনে করে থাকে।
গত এক যুগের হিসাব করলে নারীকে সমাজের মূলস্রোতে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে নারী ও শিশু নির্যাতন রোধকল্পে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১, জাতীয় শিশুনীতি-২০১১, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০, শিশুদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে শিশু আইন-২০১৩, নারী ও শিশুসহ মানব পাচার রোধে একটি সমন্বিত আইন ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন-২০০৯ ইত্যাদি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নারী ও শিশু পাচার রোধে ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ এবং ‘অ্যাসিড মামলা মনিটরিং সেল’ গঠন করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে।
দেশের ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৪০টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সপ্তাহে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা সহায়তা করার জন্য সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টোল ফ্রি ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার (১০৯) চালু করা হয়েছে। এসব উদ্যোগ গ্রহণের পরও নারী নির্যাতন আমাদের দেশের প্রতিদিনকার ঘটনা। শুধু বাইরেই নয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, শতকরা ৮০ ভাগ নারী তার নিজঘরেই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার।
নারী নির্যাতন যে কতটা ভয়াবহ ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে তা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। সারা দেশেই নারী নির্যাতন নানারূপে ও মাত্রায় সংঘটিত হচ্ছে এবং এর ফলে আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ধর্ষণ, হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি বহুমাত্রিক সহিংসতা নারীর জীবনের নিত্যসঙ্গী।
প্রতিটি নির্যাতনেরও রয়েছে বিভিন্ন রূপ ও মাত্রা। সাইবার ক্রাইম বা মোবাইল, ইন্টারনেট, ফটোশপ ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারী ও কিশোরীদের হয়রানি ও নির্যাতনও থেমে নেই। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের পাশাপাশি এ কারণে হত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে।
বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে প্রতিদিন কতজন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, এর সঠিক পরিসংখ্যান আসলেই দুর্লভ, কেননা সব ঘটনার মামলা হয় না, অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে এসব চেপে যান। নির্যাতন যে পরিমাণ ঘটে তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যকের খবরই প্রকাশিত হয় কিংবা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নজরে আসে।
বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ আজ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছেন। বস্তুত, আমাদের সবারই উচিত নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং অন্যদেরও উৎসাহিত করা। নারী নির্যাতনমুক্ত সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে নিজে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি আমাদের আশপাশে ঘটে যাওয়া যেকোনো নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে সম্মিলিতভাবে। কারণ নারী নির্যাতনকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের নীরবতা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকায় কিংবা সচেতনতার অভাবে জনসাধারণ সেসব আইন ও নীতিমালার সুফল ভোগ করতে পারেন না। এ বিষয়ে আমরা আমাদের গণমাধ্যমের আরও জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করি।
এর পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যথাযথ তৎপরতার অভাবে কিংবা আইনের ফাঁক-ফোকরের কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এর ফলে একদিকে যেমন অন্য অপরাধীরা উৎসাহিত হয়, অন্যদিকে নির্যাতিত নারীরাও আইনের আশ্রয় নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিছু নির্যাতনের ক্ষেত্রে আইনের অভাবও নারী নির্যাতনের জন্য দায়ী।
নারী নির্যাতন বন্ধে সিডও সনদ ও বেইজিং প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু আন্তর্জাতিক দলিল প্রণীত হয়েছে, কিন্তু তা যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে নারী নির্যাতন হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। তাই এসব নীতিমালা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
বিশেষ করে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত অর্থ ও সম্পদ বরাদ্দ, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা, এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা যথাযথ প্রয়োগের ব্যাপারে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
আপনার মতামত লিখুন :