অমলকে নিয়ে আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-পড়শীদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মাহারা ছেলেটা সৎ মায়ের সঠিক যত্নআত্তি পাবে তো?
কিন্তু সবাই এ কী দেখছেন!
রানু বেগম অমলকে পরম যত্নে বুকে আগলে রেখেছেন। অমলের মুখে নিজের হাতে খাবার তুলে খাওয়ান। অথচ নিজের সন্তান রতনকে থালায় খাবার দিয়ে বসিয়ে দেন যাতে সে নিজে খায়। অমলকে নিজের হাতে গোসল করিয়ে দেন। ওদিকে রতন নিজেই গোসল করে। বাইরে বের হলে অমলকে কোলে কোলে রাখেন। অন্যদিকে রতনকে হাঁটিয়ে নিয়ে যান।
অমলের প্রতি সৎ মা রানু বেগমের এই ভালোবাসা দেখে সবাই শান্তি পেলেন। কে বলবে, অমলের সৎ মা রানু বেগম? বরং নিজের মায়ের চেয়েও বেশি। সৎ মায়ের কাছ থেকে এমন যত্নআত্তি আর কেউ পেয়েছে কি না কেউ কস্মিনকালেও শোনেনি। ব্যস, সৎ মা রানু বেগমের সুনাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
একদিন রানু বেগমের মা এলেন বিষয়টা নিজের চোখে দেখতে। এসে দেখলেন ঘটনা সত্যি! বিকেলে অমলকে খাটের উপর বসিয়ে তেল পাউডার মেখে দিচ্ছেন রানু বেগম। ওদিকে রানুর নিজের ছেলে রতন উঠানের কাদা-পানিতে দৌড় ঝাঁপ করে বেড়াচ্ছে। নিজের ছেলের দিকে রানুর যেন খেয়ালই নেই। নিজের মেয়ের ঘরের নাতির এই করুণ অবস্থা দেখে আর সহ্য করতে পারলেন না রানু বেগমের মা। মেজাজ চড়িয়ে জানতে চাইলেন, নিজের ছেলের যত্নের দিকে খেয়াল নেই। সতীনের ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা করছিস!
রানু বেগম মুচকি হাসলেন। বললেন, আমাকে ভুল বুঝো না মা। আমি ঠিক কাজই করছি।
কোথায় ঠিক কাজ করছিস? দেখে মনে হচ্ছে অমল তোর নিজের ছেলে আর রতন তোর সৎ ছেলে। এসব কী শুরু করেছিস?
রানু বেগম বললেন, তাহলে শোনো মা। আমি সতীনের ছেলেকে কোলে কোলে রাখি যাতে ও ঠিকঠাকমতো হাঁটতে না পারে। ওকে খেলতে যেতে দেই না। খেলতে গেলেই তো সর্বনাশ! ওর শরীর শক্তপোক্ত হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
বাইরে বের হতে দেই না। বাইরে বের হলেই তো বাস্তব জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করবে। আরদশটা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করবে। কথা বলা, মানুষের সঙ্গে চলাফেরা শিখে যাবে। মোটকথা জীবনে যাতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ছোটবেলা থেকেই ওকে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে রাখি। এতে পাড়ার মানুষের কাছেও আমার সুনাম, অন্যদিকে সতীনের ছেলের ভবিষ্যৎও অন্ধকার। সারাজীবন ও শারীরিক, নয়ত বুদ্ধি কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে থাকবে।
কথাটা শুনে রানু বেগমের মা অমলের ভবিষ্যৎ দেখতে পেলেন। অমল কখনও স্বনির্ভর হতে পারবে না।
আসলে শিশুদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হয় ছোটবেলা থেকেই। এই স্বনির্ভরতা থেকেই শিশুর মধ্যে আরো কিছু বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। স্বনির্ভরতা বাড়ানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করিয়ে দিতে হবে। আর এই আত্মবিশ্বাসটা আসে সফলতার ওপর। শিশুকে এমন কিছু কাজের মধ্যে জড়ানো যেতে পারে, যাতে সে নিশ্চিত সফল হয়। আর এই সফলতাই তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুকে প্রথমত নিজের কিছু কাজ নিজেকেই করতে দেওয়া দরকার। যেমন খাওয়া। নিজের হাতে ধরতে পারার সময় থেকেই শিশুকে তার নিজের খাবার নিজে খাওয়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার। নিজে নিজে খেতে পারা শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এবং একবার কোনো কাজে সফলতা পেলে, শিশু নিজে নতুন কিছু করার প্রতি আগ্রহী হয়।
এরপর হতে পারে নিজের বালিশটা নিজে জায়গামতো রেখে শোয়া। কিংবা নিজের বিছানার চাদর ঠিকঠাক করা। নিজেই নিজের খেলনা গুছিয়ে রাখা। তারপর একটু বড় হয়ে উঠলে ঘরের ছোটখাট কাজগুলোর দায়িত্ব সন্তানকে দেওয়া। যেমন রান্নার সময় ছোটখাট সাহায্য করা কিংবা খাবার টেবিল গোছানো। আশপাশের দোকান থেকে কোনো জিনিস কিনতে পাঠানো। নিজের কাপড়-চোপড় নিজে পরা। পাশাপাশি শিশুর নিজের কাপড়-চোপড় তাকে দিয়েই পরিষ্কার করানো। পোষা প্রাণীদের যত্নআত্তি করা, খাবার দেওয়া। স্কুলে যাওয়ার সময় তার বইয়ের ব্যাগ তাকেই বহন করতে দেওয়া। আবার পারিবারিক ভ্রমণে শিশুকে তার নিজের ব্যাগটা তাকেই বহন করতে দেওয়া। কিংবা কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে, শিশু কী খাবে সেটাও তার নিজেকে নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেওয়া। শিশুর ওপর কোনো সিদ্ধান্ত না চাপিয়ে, তাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া। শিশু যদি ভুল সিদ্ধান্তও নেয় তবু তাকে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ভুল থেকেই শিশুরা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল শিখবে। তবে বড়দের খেয়াল রাখতে হবে, যে সিদ্ধান্ত শিশু নিয়েছে তা তার জন্য ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক কি না। ছোটবেলা থেকে এসব ছোট বিষয়গুলো শিশুর মধ্যে স্বনির্ভরতা তৈরি করে। সব কাজে শিশু সফল হবে না, এটা যেমন সত্যি, তেমনি সফল না হলেও নতুন কোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য তাকে উৎসাহ দিয়ে যাওয়া দরকার। তাতে ব্যর্থ হওয়ার পরেও শিশু হতোদ্যম হবে না। এবং ব্যর্থতার দায় অপরের ওপর না চাপিয়ে নিজের ভুলত্রুটি থেকে শোধরানোর উপায় খুঁজে নেওয়ায় সহযোগিতা করে। এতে শিশুর ব্যক্তিত্বের গঠনও মজবুত হয়।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২২ সালের অক্টোবরে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্বনির্ভর শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিশেষ সফল। পরবর্তী জীবনে সামান্য প্রশিক্ষণেই স্বনির্ভর শিশু অসামান্য দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এবং তারা ভীষণ রকম নিয়মানুবর্তী হয়ে ওঠে। আর এই স্বনির্ভর শিশুরা সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
শিশুকে স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলার প্রথম শিক্ষাটা আসে পরিবার থেকে। তারপর বিদ্যালয় থেকে। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন কিছু শিক্ষাক্রম রাখা দরকার, যাতে শিশু স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে জাপানি শিশুদের শিক্ষাক্রমের দিকে তাকালে বোঝা যায়, সেখানে মুখস্থবিদ্যার চেয়ে প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিশুকে হাতে কলমে শেখানো হয়। ছয় বছরের পর জাপানি শিশুরা নিজে নিজে বিদ্যালয়ে যায়। বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব কম হলে ওরা পায়ে হেঁটে চলে যায়। আর বেশি দূরত্বের হলে নিজে নিজেই বাস বা ট্রেনে করে বিদ্যালয়ে যায়। এমনকি টোকিওর মতো পৃথিবীর ভীষণ ব্যস্ততম শহরেও শিশুরা নিজে হেঁটে স্কুলে যাওয়া-আসা করে।
প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে তার সন্তানের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। সন্তানের প্রতি বাবামায়ের নিশ্চয়ই অনেক দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু দায়িত্বের নামে সন্তানকে কিছুই করতে না দেওয়া, শিশুর জন্যই ক্ষতিকর। অনেক সময় আমাদের বাবা-মায়েরা বলেন, আমার ছেলে বা মেয়ে তো নিজের হাতে এক গ্লাস পানি পর্যন্ত ঢেলে খায় না। আমাদের সমাজে বিষয়টাকে অনেকেই গর্ব হিসেবে দেখেন। কিন্তু এটা কি সত্যিই গর্ব করার মতো বিষয়? সেই শিশু জীবনের যে কোনো পরিস্থিতিতে কখনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? বাবা-মা কিংবা অভিভাবক হিসেবে কি তাকে আজীবন আগলে রাখা যাবে? শিশু বয়স থেকে পারিবারিক স্বনির্ভরতার প্রশিক্ষণ না পেলে, বড় হয়ে কি সে নিজে নিজে স্বনির্ভর হতে পারবে? কখনোই না।
আমরা কি আমাদের সন্তানদের স্বনির্ভর দেখতে চাই না? যদি না চাই, তাহলে ভিন্ন কথা। আর যদি চাই, আমাদের সন্তান স্বনির্ভর হোক, আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকুক, তাহলে আমরা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে পারি, আমরা কি আমাদের শিশুদের সেই সৎমায়ের সন্তান অমলের মতো লালন-পালন করছি?
আমাদের সন্তান অমলের মতো বড় হয়ে উঠুক, এটা আমরা চাই না। আর যদি না চাই, আমাদের আচরণ যাতে রানু বেগমের মতো না হয়। কারণ স্বনির্ভর শিশু মানেই স্বনির্ভর জাতি।
আপনার মতামত লিখুন :