ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

বাজার ব্যর্থতা ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বপ্রবণতা

মো. আইনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৪, ১২:০০ পিএম

বাজার ব্যর্থতা ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বপ্রবণতা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা আবারও শুরু হয়েছে, কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। লাগাম টানতে সুদের হার বারবার বাড়ানোসহ আরও কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও সুফল মিলছে না নিত্যপণ্যের বাজারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদকৃত হিসাবে নভেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিবিএসের মতে, ১ মাস ব্যবধানে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ০ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে। অর্থাৎ অক্টোবরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অপরদিকে গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড করে নভেম্বরে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা অক্টোবরে ছিল ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর এ সময়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ হয়েছে; যা অক্টোবর মাসে ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বিবিএস বলছে, গড় ভোক্তা মূল্য সূচক বা কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স (সিপিআই) পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির হিসাবের ফলে খাদ্যপণ্যের মূল্য ১ দশমিক ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও বেড়ে গেছে। এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের নির্মোহ অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিলেন যে, রাজনৈতিক সুবিধা পেতে আগে মূল্যস্ফীতি কম দেখানো হতো। চলতি সপ্তাহে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত কমিশনের প্রকাশিত শ্বেতপত্র প্রতিবেদনেও বিবিএসের পরিসংখ্যানে কারসাজি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। শ্বেতপত্র বলছে, গত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১৫ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। কিন্তু বিবিএসের প্রকাশ করা পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতি অনেক কম দেখানো হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থনৈতিক নীতিনিধারকরা কার্যভার নেওয়ার শুরুতেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হবে এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে জনগণের কষ্ট লাঘবে সবধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য মূল্যস্ফীতি কমার লক্ষণ দেখা গেলেও এখন আবার তা বাড়াছে। অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর দুজনেই দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ চলমান বলে জানিয়েছেন। গভর্নর গত বন্যার কারণে বর্তমানে বাজারে সবজি ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তি হওয়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কথা জানিয়ে বলেছেন, ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ এবং ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে (২০২৫-২৬ অর্থবছরের মাঝামাঝি) ৫ শতাংশে নামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, মূল লক্ষ্য ৪-৫ শতাংশ।

অর্থনীতি শাস্ত্রের মানুষ হিসেবে সাধারণ মূল্যায়ন হচ্ছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আরও কিছুটা সময় ধরে বজায় থাকার আশঙ্কা আছে। কেন এই আশঙ্কা, তা ব্যাখ্যা করার আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, এ দেশের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠই নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ। তারা অর্থনীতির গভীরে ক্রিয়াশীল কার্যক্রমের পরিসংখ্যানিক কারসাজি তো দূরের কথা সাধারণ তথ্য-তত্ত্বও বোঝে না। তারা রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতির অংশ হিসেবে যতটুকু আয় করতে পারে, ততটুকু ব্যয় করতে পারলেই সন্তুষ্ট। কিছুটা সঞ্চয় হলে খুশি। আর সঞ্চয়টুকু দেখেশুনে লাভযোগ্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারলে তো মহাখুশি। কিন্তু নানা কারণে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ এই মানুষেরা আয়-ব্যয়-সঞ্চয়-বিনিয়োগ কোনো সূচকেই ভালো নেই। অনেকেরই ধারদেনা করে সামনে দিন বদলাবে চিন্তায় দৈনন্দিন জীবনলিপি চলছে। দেশের বর্তমান অবস্থা তারা বোঝে। বোঝে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মোটামুটি শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করেছে। তাই তারা সঞ্চয়-বিনিয়োগ করতে পারছে না। আয়ের চেয়ে কিছুটা বেশি ব্যয়ও তারা এখন মেনে নিচ্ছে। কারণ, অনেক দিন ধরেই এমনটা তাদের চলছে। এসবই সত্যি। কিন্তু এই মানুষেরা যদি আয়-ব্যয়ের ক্রমাগত বাড়তে থাকা চক্রে পড়ে ধার-দেনার গর্তে পড়ে যান, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যত ভালো ভালো কথাই বলুক না; বন্যা, চক্রান্ত, ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধ-সংঘাতের যত কার্যকারণ দেখাক না কেন- জনগণের চক্ষুশূল হয়ে যাবে। আরও খোলাখুলিভাবেই বলা যায়, মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে ব্যর্থ হলে এবং এটি ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে সহ্যের সীমা ছাড়ালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াই বড় দায় হবে। কেননা ঐতিহাসিকভাবে, মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্য সংকোচন উভয়ই জনগণের চরমতম শত্রু। দুটিই গণতান্ত্রিক কিংবা কর্তৃত্ববাদী সরকারের জন্য অ্যাসিড টেস্ট হিসেবে কাজ করে। এর কারণ অর্থনীতির এই দুই অনুষঙ্গ একটি দেশের রাষ্ট্র পরিচালক-রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা সরকার এবং জনগণের মধ্যে সামাজিক চুক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এর লঙ্ঘন হলে জনগণ সরকারকে ওয়াদা ভঙ্গকারী মনে করে গদি থেকে উৎখাত করে, যার প্রমাণ বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে অসংখ্য আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেন, শ্রীলঙ্কা, ভেনিজুয়েলা, জিম্বাবুয়ে, আর্জেন্টিনা প্রভৃতি দেশে সহ্যের অতীত মূল্যবৃদ্ধি বা মূল্যস্ফীতির কারণে সরকারের পতন হতে দেখা গেছে। জার্মানিতে আবার মূল্য সংকোচনের অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম পড়ে যাওয়ার জেরে ১৯৩০-এর দশকে ফ্যাসিস্ট হিটলারের ক্ষমতায় আরোহণ সহজ হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকের দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে নিজেদের মনমতো পরিচালিত করতে নানা শক্তি বর্তমানে কাজ করছে, যাদের প্রধান হাতিয়ার জনগণের চরমতম শত্রু মূল্যস্ফীতি কিংবা মূল্য সংকোচনও হতে পারে। পাশাপাশি বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও দিন দিন নাজুক হচ্ছে। সুতরাং বলা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তথা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামনের দিনগুলোর পথচলা যথেষ্ট কণ্টকাকীর্ণ।

এখন আসা যাক, বাংলাদেশে সামনের কিছুদিন মূল্যস্ফীতি প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী থাকার আশঙ্কার পেছনে কী কী যুক্তি আছে। সাধারণভাবে বলা যায়, কোনো দেশের দ্রব্য বা সেবার মূল্য বার্ষিক মেয়াদন্তে বৃদ্ধি পাওয়াকে মূল্যস্ফীতি বোঝায়। যেমন দেশে ২০২৩ সালের নভেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় মিলেছে, তা এ বছরের নভেম্বরে কিনতে ব্যয় করতে হয়েছে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা। এখানে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ১১.৩৮ শতাংশ। মূলত মূল্যস্ফীতির কারণে প্রতিটি আর্থিক ইউনিট কম পণ্য ও পরিষেবা কিনতে পারে। মূল্যস্ফীতির জের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ভিন্ন হলেও অর্থের মূল উপজীব্য মানুষের জীবনযাপনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। পুঁথিগত দৃষ্টিতে মূল্যস্ফীতি সাধারণত চারটি কারণে হতে পারে। যেমন চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি হলে, চাহিদা জোগানকে ছাড়িয়ে গেলে, অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে এবং উৎপাদন হ্রাস হলে। এই দৃষ্টিতে মূল্যস্ফীতি দুধরনের চাহিদা বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বা ডিমান্ড পুল ইনফ্লেশন (অত্যধিক অর্থ খুব কম জিনিসের পেছনে ছুটতে থাকে) এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি বা কস্ট পুশ ইনফ্লেশন (মজুরি-কাঁচামালের সংগ্রহে বেশি অর্থ খরচ হওয়া)। আধুনিক অর্থব্যবস্থা বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, তথাকথিত উদার নীতির মুক্তবাজার ও সর্বোতভাবে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকটসহ পারিপার্শ্বিক আরও কিছু কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটতে পারে। যেমন, বাংলাদেশে এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভালো নেই অর্থাৎ সংকট চলছে। এতে করে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়ছে। বর্তমানে দেশে দৃশ্যমান মূল্যস্ফীতির কারণ বোঝার জন্য অন্য কারণসমূহ আলোচনার আগে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটকালে মূল্যস্ফীতি ঘটার বিষয়টি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এর কারণ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মূল্যস্ফীতিসহ অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীরভাবে পারস্পরিকভাবে প্রভাব ফেলে। যেমন-

১. সরবরাহ সংকট
- রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পণ্য ও সেবার সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। 
- যে কোনো পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত হলে পণ্যের বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে না, ফলে দাম বেড়ে যায়।

২. উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি 
- সংকটজনিত কারণে জ¦ালানি, কাঁচামাল ও শ্রমের খরচ বেড়ে যায়। 
- উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেই খরচ ভোক্তাদের ওপর চাপানো হয়, যা মূল্যস্ফীতি বাড়ায়। 

৩. মুদ্রার মান কমে যাওয়া 
- রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সংকটে দেশীয় মুদ্রার মান কমে যেতে পারে। 
- মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেলে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করে। 

৪. নগদ অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি 
- সংকট মোকাবিলায় সরকার অতিরিক্ত অর্থ ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি হয়। 
- অর্থনীতিতে অতিরিক্ত নগদ অর্থ প্রবাহিত হলে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়, যা দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। 

৫. বিশ্বাসের অভাব 
- রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পায়, ফলে বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। 
- ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

৬. আমদানি-নির্ভরতা 
- অর্থনৈতিক সংকটকালে পারিপার্শ্বিক কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যায়। 
- মুদ্রা অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিরতায় আমদানিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটে। 

৭. সরকারি নীতির প্রভাব 
- সংকট মোকাবিলায় নীতিমালা ত্রুটিপূর্ণ হলে পণ্যের মূল্যে প্রভাব নেতিবাচক পড়ে।

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় চরম মূল্যস্ফীতির প্রমাণ আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যুদ্ধ-সংঘাত ও অস্থির পরিস্থিতিতে খাদ্য এবং জ্বালানির সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়ে। সহজভাবে বলা যায়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মূলত চাহিদা এবং সরবরাহের ভারসাম্য নষ্ট করে বাজারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির অন্য ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবের সঙ্গে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি এখনকার মূল্যস্ফীতির চড়া দশার পেছনে কাজ করছে, সেটি হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত বিশৃঙ্খলতা। আইন প্রণয়নের জাতীয় সংসদসহ রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী পুঁজিপতিদের একচ্ছত্র আধিপত্য এবং দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র পণ্য ও সেবার বাজার ব্যবস্থার কাঠামোগত ভিত্তি প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। এখানে কৃষকের ঘাম-শ্রমে উৎপাদিত পণ্য প্রথম ধাপে কৃষকের পর ৬ বার হাতবদল ঘটে ভোক্তা (কৃষক থেকে বড় পাইকার-মহাজন, সেখান থেকে কোল্ড স্টোরেজ-গুদাম মালিক, সেখান থেকে রাজধানীর আড়ত-কমিশন এজেন্ট, সেখান থেকে ছোট পাইকার, তার কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতা; শেষে ভোক্তার হাত)। আর এই ছয় হাত বদলের পর পণ্য পরিবহন পথে ১০ জায়গায় চাঁদাবাজি হয় (রাজনীতিবিদ ও দলের ৩টি হাত, পুলিশের ২টি হাত, প্রশাসন ২টি হাত, পরিবহন সমিতি ২টি হাত, ব্যবসায়ী সমিতি ১টি হাত, মস্তান-সন্ত্রাসী ১টি হাত)। এরপর আবার ভোক্তার হাতে তুলে দেওয়ার আগে নিয়োজিত ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা করে জ¦ালানি তেল, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা অজুহাত-ওছিলায়। আর এসব করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আইনে ইচ্ছাকৃত ফাঁকফোকর রাখা হয়, যতটুকু বা আইনের সুযোগ আছে, তাও ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আটকে দেওয়া হয়। আর এসব কারণে ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়া তো দূরের কথা ট্রেড লাইসেন্সই না করা উড়ে আসা ফড়িয়া পাইকারি ২২ টাকায় কেনা ১ কেজি আলু ৪৮ টাকা লাভে ৭০ টাকায় খুচরা বিক্রেতার হাতে তুলে দেয়। সেই আলু আবার খুচরা বিক্রেতা ৯০ টাকায় ভোক্তাকে দেয়। আর এসব অপকর্ম নির্দ্বিধায় চলমান রাখতে আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন ও নজরদারি-জবাবদিহি ব্যবস্থা এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়, যাতে করে দিনশেষে আসলে সাধারণ মানুষের জন্য অশ্বডিম্ব সৃষ্টি হয়।

বাজার ব্যবস্থায় বহাল তবিয়তে চলমান এসব নৈরাজ্যসহ সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে আস্থা ফেরাতে টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোয় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা তারল্য সহায়তা দিয়েছে। এতে করে গ্রাহকদের মনে স্বস্তি দেখা গেলেও অর্থনীতির সূত্র মেনে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আবার উচ্চ-সুদহারের কারণে অস্থিরতাও বিরাজ করছে শিল্পমালিকদের মনে, যারা আরও বিনিয়োগের পরিবর্তে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে নিয়োজিত। এসবের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকারিভাবে টিসিবি, ওএমএসসহ বেশকিছু কার্যক্রমের আওতায় খাদ্যশস্য (চাল ও গম) বিতরণের যে কার্যক্রম সরকার থেকে চালানো হয়, সেখানেও দেখা দিয়েছে টানাপোড়েন। খাদ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস (১ জুলাই থেকে ২৩ নভেম্বর) সময়ের মধ্যে আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) একই সময়ের তুলনায় খাদ্যশস্য বিতরণ তো বাড়েইনি উল্টো কমেছে ৭১ হাজার ৩১৮ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারি ভান্ডার থেকে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়েছিল ১২ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৮ টন, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার ৪৫০ টনে। সবচেয়ে ঝুঁকির বিষয় বিতরণ না বাড়লেও দেশে সরকারি খাদ্যভান্ডারের মজুদ দ্রুতই কমছে। গত চার মাসে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ কমেছে ৩৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় গত ৭ আগস্ট দেশে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ ছিল ১৮ লাখ ৯ হাজার ৮৫৭ টন, যার মধ্যে চাল ও গম যথাক্রমে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৪ টন ও ৪ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৩ টন। ফলে দেশে বর্তমানে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাদ্যশস্যের মোট মজুদ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯০ হাজার ৩১৪ টনে (চাল ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৪১ টন, গম ৪ লাখ ২০ হাজার ৩০৩ টন)। অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রায় চার মাসে দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ কমেছে ৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৩ টন। সরকারিভাবে স্বাভাবিক নিয়মে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে চাল ও গম সংগ্রহ করে মজুদ সময়মতো করতে না পারাতেই এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখন যদি চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে তাহলে স্বাভাবিক কারণেই মূল্যস্ফীতির পারদ আরও উপরে উঠে যাবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য আগে থেকে সরকারিভাবে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও আমদানি বাড়ানোর প্রয়োজন ও সুযোগ থাকলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনভিজ্ঞতার সুযোগে প্রশাসনিক শৈথিল্য পরিস্থিতি ক্রমশই নাজুক করছে।

এমন এক অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থনীতি নির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে সমন্বিতভাবে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগী হতে হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাক্সিক্ষত পর্যায়ে আনতে হলে সবার আগে রাজস্ব ও আর্থিক নীতিসমূহ সমন্বিত করতে হবে। মুদ্রানীতি, সরকারি ব্যয়, ব্যাংকের ঋণ খেলাপি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ নেওয়া-দেওয়ার বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থনীতির সংকট-বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে টাকা ছাপানো দোষের কিছু না। কিন্তু কত টাকা ছাপাতে হবে এবং ছাপানো টাকা উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হলো কি না, সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেবল মুদ্রানীতি নিয়ে কাজ করলে হবে না, একই সঙ্গে লক্ষ্য অর্জনের জন্য আর্থিক খাতের কাঠামোগত শৃঙ্খলা ও বাজার ব্যবস্থাপনার প্রথাগত বিশৃঙ্খলার সংস্কৃতি দ্রুত ঠিক করতে হবে। আর তা না-হলে মূল্যস্ফীতির গড্ডলিকা প্রবাহে পড়ে জনগণসহ নিজেদেরও ডুবে যেতে হবে।

আরবি/এফআই

Link copied!