ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫

জিয়াউর রহমান: সমরনায়ক থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক

মো. হারুন-অর-রশিদ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৩, ২০২৫, ০২:০০ পিএম

জিয়াউর রহমান: সমরনায়ক থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাঙালি জাতির মহাক্রান্তিকালে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশ, ঠিক সেই সময়েই জাতিকে মুক্ত করার জন্য গর্জে উঠেছিলেন একজন অখ্যাত মেজর জিয়াউর রহমান। 

একজন সাহসী রাজনৈতিক নেতার মতোই নিজ জাতিকে রক্ষা করার জন্য জীবন, স্ত্রী-সন্তানের নিরাপত্তার কথা না ভেবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ‘আমরা বিদ্রোহ করলাম’ বলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। 

শুধু তাই নয়; ২৬ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সূচনা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক শুনে সাত কোটি মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। 

যুদ্ধের মাঠে নিজে যুদ্ধ করেছেন, সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। অবশেষে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। এই সেনানায়ক রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে সম্মান জানিয়ে রাজনীতির মাঠেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। 

দেশ শাসন করেছেন একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়কের মতোই। একটি অস্থিতিশীল, অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন দরিদ্রতম রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আমলে ‘তলাবিহীন’ খেতাবপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকে উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এমন মহান রাষ্ট্রনায়কের আবির্ভাব কোনো জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের ‘জেড’ ফোর্সের এই অধিনায়ক রাজনীতিতে না এলেও পারতেন। কিন্তু সময় ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জনগণের চাওয়াকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। আবার তিনি একজন সেনাশাসক হয়েও রাষ্ট্র চালাতে পারতেন। না, তিনি সে পথে যাননি। 

তিনি স্বাধীনতার মূল স্পিরিটকে ধারণ করে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিলুপ্তকৃত গণতন্ত্রকে পুনর্জীবন দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংমিশ্রণে তিনিও একটি রাজনৈতিক দল সৃজন করেছিলেন। 

তার তৈরি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি সূচনাকালীন থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে টিকে আছে। জিয়াউর রহমান অবশ্যই আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং স্বাধীনতার ঘোষণাকারী জর্জ ওয়াশিংটন, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটু, তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মতো ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে থাকবেন। 

কারণ, তিনিও তাদের মতো সমরনায়ক হয়েও রাজনৈতিক দল গঠন করে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত করে।

কিছু কুচক্রীমহল বলে থাকেন, জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। ওই কুচক্রী মহলের মনে রাখা দরকার, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী দল ক্যান্টনমেন্ট থেকে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রাজপথে দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত চাহিদার অন্তর্নিহিত এক ফসল। 

পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের ধারা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বিএনপি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখার বলিষ্ঠ শক্তিমান দল। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে গণতন্ত্রের মা বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান সেই ঝান্ডা বহন করে স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং নির্ভেজাল সংসদীয় গণতন্ত্রকে অক্ষুণ্ন রাখার এক লড়াকু অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক শুরুর প্রেক্ষাপট জনগণকে কেন্দ্র করে। মূলত জিয়াউর রহমানকে রাজনীতির মধ্যে অন্তর্নিহিত করেছে সিপাহি-জনতার দাবি। যে কারণে জিয়াউর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাকে ব্যক্তিতন্ত্রের মন্ত্রে আবদ্ধ করলে জনগণ কিছুতেই তা বরদাস্ত করবে না। 

তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ তথা জনগণ তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে যথার্থভাবে, যা ছিল বাঙালির স্বাধীনতার চেতনার মূল চাওয়া। তাই রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে জিয়াউর রহমান ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত গণতন্ত্রকে দেশে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য গণতন্ত্রায়নের উদ্যোগ নেন। 

তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি একদলীয় বাকশালী প্রক্রিয়াকে বাদ দিয়ে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে সচেষ্ট হন। এই উদ্দেশ্য জিয়া সরকার ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই এক নতুন রাজনৈতিক দলবিধি  প্রণয়ন করেন এবং ‘রাজনৈতিক দলবিধি’ জারি করে ২৩টি রাজনৈতিক দলকে অনুমোদন করে গণতান্ত্রিকতার পথে প্রবেশ করেন। 

বিদেশি সাহায্য ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত জাতীয় স্বার্থভিত্তিক এবং প্রতিটি অঙ্গ সংগঠনসহ রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি দেন। গণতান্ত্রিক পরিসরকে বৃহত্তর করার জন্য ১৯৭৪ সালের আদম শুমারির ওপর ভিত্তি করে জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের জন্য সমগ্রদেশকে বিভক্ত করা হয়। 

শুধু রাজনৈতিক দল গঠন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যেই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জনসাধারণের সুখ ও সমৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় সংহতি সুদৃঢ়করণ ও সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূিচকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যা ছিল সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার মূল মন্ত্র।

জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় দেশে গণতন্ত্র ছিল না, জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিপরিষদ ছিল না, সংবিধানও স্থগিত ছিল, আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু ছিল না, সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছিল বহুধাবিভক্ত এবং দ্বন্দ্বে লিপ্ত, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের  স্বাধীনতা ছিল না, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিল এক ধরনের হতাশা এবং আদর্শের দ্বন্দ্ব এই পরিস্থিতির মধ্যে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। 

ক্ষমতায় আসার পর তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন। রাজনীতিকে করে দেন উন্মুক্ত, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন দ্রুত সময়ে। 

সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি সামরিক শাসনকে দীর্ঘায়িত না করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে বিকাশমান করতে পেরেছিলেন। সুতরাং জিয়াউর রহমান তার শাসন আমলে রাজনৈতিক অগ্রগতি সাধন করতে পেরেছিলেন এটি স্পষ্টত প্রমাণিত। 

একটি আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গঠন করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯ দফার মাধ্যমে দেশের কৃষি এবং শিল্পকে উন্নয়নই নয়; জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করার প্রথম প্রচেষ্টা জিয়াউর রহমানই করেছিলেন। কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এক উচ্চমার্গে নিয়ে যান জিয়াউর রহমান। 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। যখন তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তখন প্রতিবেশী ভারত ছিল বৈরীভাবাপন্ন। অন্যদিকে তখনো চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্নমুখী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়নি। 

জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক সফলতার মাধ্যমে ভারতের খবরদারি থেকে যেমন রাষ্ট্রকে বের করে আনতে সফল হয়েছিলেন তেমনি পাকিস্তান, সৌদি আরব ও চীনের কাছ থেকে  স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি এনেছিলেন। 

জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ, জোট নিরপেক্ষ গ্রুপের সঙ্গে আরও সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা, চীনের সঙ্গে সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক স্থাপন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করা ছিল অন্যতম। 

জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তিনি নিজে ১৯৭৭ সালের জুন মাসে চীন ভ্রমণ করে চীনকে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও স্বার্থ সমন্ধে সচেতন করে তোলেন। 

জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭৭-৭৮ সালে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) সঙ্গে বাংলাদেশের বৈরী সম্পর্ককে ১৯৮০ সালে সৎপ্রতিবেশীসুলভ করে তোলে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি নে উইন বাংলাদেশ ভ্রমণ করে বাংলাদেশ ও বার্মা সীমান্ত চুক্তি এবং ঢাকা-রেঙ্গুন সহযোগিতা চুক্তি করতে সক্ষম হয়। 

১৯৭৯-৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়ার জাপান, উত্তর কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সফর এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্নমুখী বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক চুক্তি দূরপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে তোলে। 

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নানাবিধ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে ‘সার্ক’ (রিজিওনাল কো-অপারেশন ইন সাউথ এশিয়া) প্রস্তাব করেন। যার প্রেক্ষিতেই এই অঞ্চলের ৭টি রাষ্ট্র নিয়ে ‘সার্ক’ গঠন করা হয়।  

সহজ কথায় বলা যায়, বৈদেশিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে তিনি খুবই সফল হয়েছিলেন। অন্যদিকে যেসব কার্যক্রম রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনয়ন করে, জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দান করে, নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে সামাজিক প্রয়োজন প্রতিফলিত হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয় সেই ব্যাপারে তিনি ব্যাপক কার্যক্রম চালু করেছিলেন। তিনি সফলও হয়েছিলেন। 

জিয়াউর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সব ভেদাভেদ ভুলে জাতি যখন ঐকবদ্ধ হয়েছিল, রাষ্ট্র যখন উন্নয়নের পথ ধরে হাঁটছিল, মানুষ যখন গণতন্ত্র ও সাম্যের অধিকার ভোগ করার উন্মুক্ত পরিবেশ পেয়েছিল ঠিক তখনই আট কোটি মানুষের প্রিয় প্রেসিডেন্ট শহিদ হলেন, সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ঘাতক কিছু সেনার গুলিতে। দেশ হারাল একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক, একজন মহান নেতা এবং আট কোটি মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টাকে।


লেখক: রাজনীতিক, কলাম লেখক
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!