সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এশিয়ান টাইমস ও দ্য কনভার্সেশনে টিউলিপ সিদ্দিক ও বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরিবারের পতন শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ এবং শেখ পরিবারের পতনের কথা।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে এশিয়ানটাইমস এর প্রবন্ধটি শেয়ার করেছেন। রূপালী বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য উক্ত প্রবন্ধটি বাংলায় প্রকাশ করা হলো-
যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশে বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্তে নাম আসার পর ইস্তফা দিয়েছেন। তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযুক্তের তালিকায় তার খালা, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মা শেখ রেহানাও রয়েছেন। ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা গুরুতর ফৌজদারি অভিযোগের সম্মুখীন হন।
১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ব্যাপক সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর প্রবল বিক্ষোভের মুখে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগের ভেতর ব্যাপক পরিসরে আর্থিক দুর্নীতি এবং বিশাল অঙ্কের অর্থ অপব্যবহারেরও অভিযোগ করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত সহিংসতায় প্রায় ১,৫০০ মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের নবগঠিত সরকার হাসিনার শাসনামলে সংগঠিত অপরাধ তদন্তে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। হাসিনা এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আইনি প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে দুর্নীতি বিষয়ক দুটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে টিউলিপ সিদ্দিকের নামও এসেছে।
তবে বারংবার নাম আসলেও টিউলিপ সিদ্দিক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আচরণবিধি বিষয়ক উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে তার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য আবেদন করেছেন। তবে এটি কোনো দোষ স্বীকার নয়, বরং নিয়মিত প্রক্রিয়ার অংশ।
চিঠিতে টিউলিপ লিখেছেন, আমি স্পষ্ট করে বলছি যে আমি কোনো ভুল করিনি। তবে, সব সন্দেহ দূর করতে আমি নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি। ম্যাগনাস বলেছেন, মন্ত্রীসভার আচরণবিধির ভঙ্গ না করলেও টিউলিপ জনসাধারণকে তার খালার কাছের কোনো বন্ধুর থেকে উপহার পাওয়া অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীনতার নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত এবং আরও এক কোটি বাস্তুচ্যুত হন। (প্রায় ২ লক্ষ বাংলাদেশি নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিত হন।)
শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বিশাল বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট হন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে ও তার পরিবারকে হত্যা করা হয়। বিদেশে থাকায় শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা এ হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যান।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসেন। শুরুতে তাকে গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে দেখা হলেও, পরে তাকে ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। সমালোচকদের মতে, নিজের পরিবার ও নিজের সম্পতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য তিনি ক্ষমতাকে ব্যবহার। এছাড়া হাসিনা সরকার তার পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং আবাসন নিশ্চিত করতে একাধিক বিতর্কিত আইন পাশ করেন।
২০০১ সালে ‘জাতির পিতার পরিবারের নিরাপত্তা আইন’ পাস করে শেখ হাসিনার পরিবারকে নানা সুবিধা দেওয়া হয়। এসময় গণভবনকে ‘প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া তার বোন শেখ রেহানাকেও ঢাকার বনেদী এলাকা ধানমণ্ডিতে একটি বাসা দেওয়া হয়।
এছাড়াও তার আমলে আইন করে শেখ পরিবারের খরচের জন্য বিরাট অঙ্কের অর্থের টাকার অনুদান পাস করানো হয়। এসব অনুদান অনুযায়ী শেখ পরিবারের প্রত্যেক সদস্য বয়স ২৫ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের শিক্ষা ব্যয় পাবেন। সেই সঙ্গে পাবেন মাসিক ভাতাও । ২০২৪ সালে তুমুল বিক্ষোভ ও সহিংসতার মুখে ভারত পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা এসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন।
দুর্নীতির যত অভিযোগ
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করা হয়। কিন্তু ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হোয়াইট পেপার অনুযায়ী, এই অগ্রগতি ছিল ভুয়া। বিগত সময়ে অর্থনীতির মূল সূচকগুলোকে বিকৃত করা হয় এবং কয়েক বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস চুরি হওয়া সম্পদ ফেরত চেয়েছেন। তবে শেখ হাসিনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করেছে। হাসিনা এসব অভিযোগও অস্বীকার করেছেন।
হাসিনার ঢাকার বাসভবন থেকে উদ্ধার করা হয় টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক প্রচারপত্র এবং বিলাসবহুল জিনিসপত্র । এছাড়াও, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত চলছে। এই প্রকল্পের অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। টিউলিপ ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচক হিসেবে কাজ করেছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ নিউজ ২৪ (bdnews24)-এ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রূপপুরের পারমাণবিক প্রকল্পের চুক্তিতে বাংলাদেশ, ভারত এবং রাশিয়ার বিনিয়োগ জড়িত। এই ত্রিমুখী প্রকল্পে জনগণের তহবিলের লক্ষ লক্ষ ডলার আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, টিউলিপের বিরুদ্ধের অন্যান্য অভিযোগের পাশাপাশি এ প্রকল্পে তার অবদান নিয়েও তদন্ত চলছে। যুক্তরাজ্যের উর্ধ্বতন এক সরকারি কর্মকর্তার কাছে দাবি টিউলিপ দাবি করছেন, তিনি ‘পলিটিকাল হিট জব এর’শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকার সিদ্দিকের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে খুন এবং জোরপূর্বক গুম থেকে শুরু করে আর্থিক জালিয়াতি পর্যন্ত অভিযোগের বিশালতার প্রেক্ষিতে - টিউলিপের পদত্যাগ খুব ছোট ঘটনাই হওয়ার কথা।
যখন বাংলাদেশ তার নবগঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ অনুসরণ করছে তখন টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তবে বাংলাদেশে চলমান তদন্ত থেকে এটুকু পরিস্কার, এটি একটি দীর্ঘ ও জটিল আইনি লড়াইয়ের সূচনা মাত্র।
মূল লেখা: শাহজাদ উদ্দিন, ডিরেক্টর, সেন্টার ফর অ্যাকাউন্টেবিলিটি এন্ড গ্লোবাল ডেভলপমেন্ট।
ভাষান্তর: সরকার জারিফ
আপনার মতামত লিখুন :