দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ববাসী গত কয়েকদিনে যেসব সংবাদ শিরোনামগুলো দেখেছে সেগুলো ‘বিস্ময়কর’ হলেও ‘অপ্রত্যাশিত’ নয়। ইতোমধ্যে আমরা ট্রাম্পের অতি-সক্রিয়তাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়েছি। তবে আট বছর আগে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। ট্রাম্পের উত্থানকে তখন রাজনৈতিক ‘অস্বাভাবিকতা’ হিসেবে দেখা হয়েছিল। অনেকেই রাশিয়ার হস্তক্ষেপকে দায়ী করেছেন এর জন্য। এমনকি ট্রাম্প নিজেও তার বিজয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন।
এখন পরিস্থিতি বদলেছে। রিপাবলিকান এ নেতার প্রত্যাবর্তন কোনো দুর্ঘটনা নয়। নানা চড়াই উথরাই পেরিয়ে বিজয়ী ট্রাম্প এখন আরও আত্মবিশ্বাসী। তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে পুরো দল। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মহলগুলোও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার আধিপত্য মেনে নিয়েছে। কনগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি তার নিজস্ব আদর্শিক দল নিয়ে কাজ শুরু করেছেন ট্রাম্প। আসন্ন দুই বছর নাগাদ ট্রাম্পের এসব বক্তব্য বাস্তবে রূপ নিতে পারে।
বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি বছরের পর বছর অপরিবর্তিত আছে। ১৯৮০-এর দশকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুর আগ থেকেই ট্রাম্পের মতাদর্শিক অবস্থান পরিবর্তিত হয়নি। তার লক্ষ্য একটাই –আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তবে ট্রাম্প তার পূর্বসূরিদের মতো ‘ উদারনৈতিক বিশ্ব’ নেতৃত্ব চান না। ট্রাম্পের আধিপত্য বিস্তারের মডেল একান্তই লেনদেনভিত্তিক ও ব্যবহারিক। যেকোনো সম্পর্ক, জোট, বা প্রতিষ্ঠান তার কাছে তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক। যেসব সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রকে ত্যাগের বিনিময়ে কিছু দেয় না ট্রাম্প বরাবরই সেসব সম্পর্ক ছুঁড়ে ফেলে দিতে রাজি।
ট্রাম্পের আমেরিকা নৈতিকতার বড় বড় বুলিতে বিশ্বাস করে না। বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা অথবা বিশ্বের নানা ধরনের সমস্যা সমাধানে তিনি খুব একটা আগ্রহীও নন। তিনি প্রত্যেক সম্পর্ক থেকে সর্বোচ্চ লাভ করতে চান। সেটা অর্থনীতি, নিরাপত্তা বা রাজনীতি হোক না কেন। যদি কেউ ট্রাম্পের শর্ত না মানতে চায় তবে তিনি জবরদস্তির আশ্রয় নেন।
ট্রাম্প কঠোর পন্থা পছন্দ করলেও যুদ্ধ এড়াতে চান। তার জন্য এটি শান্তিপ্রিয়তা নয় বরং বাস্তবতা। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে যুদ্ধ অপচয় এবং ক্ষতিকর। তিনি মনে করেন সংঘাতের সমাধান আলোচনা দ্বারা সম্ভব। এছাড়াও তিনি একীভবন বা বাণিজ্যের মাধ্যমেও সমাধানে বিশ্বাসী- ধ্বংসের মাধ্যমে নয়।
এ কথা পরিস্কার, ট্রাম্প সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয় বরং অর্থনৈতিক দ্বৈরথ বেশি পছন্দ করেন। বাণিজ্য প্রতিযোগিতা এবং কঠোর সমঝোতার মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার মীমাংসা করতে আগ্রহী তিনি। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো এমন নীতির লক্ষ্যবস্তু হয়। এতে এসব দেশ অসন্তুষ্ট হয় এবং ক্ষমতাহীন অনুভব করে। এমন নীতি স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ করে। মোদ্দাকথা, ট্রাম্পের কাছে এমন মিত্রদের জোট তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দেয়।
ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরা রাশিয়ার জন্য মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের ‘লিবারেল ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ (উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থা)- এর বিরোধিতা মস্কোর জন্য সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। কেননা স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকা রাশিয়ার স্বার্থ উপেক্ষা করত। কিন্তু ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি জাতীয় স্বার্থের কথা বলে। ফলে উভয়দেশের স্বার্থের ভিত্তিতে নতুন চুক্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্পের এমন চিন্তাভাবনা ভুলের উর্ধ্বে নয়। কেননা তিনি সমস্যাগুলোর মূলে গিয়ে সমাধানে আগ্রহী নন। ইউক্রেনের উদাহরণই দেওয়া যাক। সেখানে ট্রাম্প টেকসই কোনো সমাধানে না গিয়ে একবারে যুদ্ধাবস্থা বন্ধ করতে চান। অন্যদিকে মস্কো একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাধান চায়। তবে এ বিষয়ে ট্রাম্প খুব একটা আগ্রহী নন।
ট্রাম্প জটিল সমাধান এড়িয়ে সহজ চুক্তি পছন্দ করেন। উদাহরণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের আব্রাহাম চুক্তির কথা বলা যায়। এসব চুক্তি ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব এড়িয়ে বাস্তববাদী এবং অর্থনৈতিকভাবে চালিত সমাধান দিয়েছে। তবে একথা সত্যি, ইউক্রেন সংঘাতে এই মডেল কাজ করবে না। এ সংঘাতের গভীর ও ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে। যা সমাধানে প্রয়োজন ধৈর্য ও জটিল সিদ্ধান্তগ্রহণের মানসিকতা।
ট্রাম্পের নেতৃত্ব সম্পূর্ণ লেনদেন-ভিত্তিক। অন্য দেশগুলোকে তাদের দক্ষতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সহযোগিতার মানদণ্ডে বিচার করেন তিনি। যেসব নেতারা তার পরামর্শ উপেক্ষা করেন তাদেরকে তিনি অযোগ্য মনে করেন। এমন চিন্তাভাবনা পূর্বেকার যেকোনো আমেরিকান প্রশাসন থেকে আলাদা এবং এসব চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশগুলোর ছড়ি ঘোরানোর মতো অবস্থায় থাকে। এর ফলে এসব দেশের সার্বভৌমত্বকে উপেক্ষা করা হয়।
এমন দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকার পুরনো পরইরাষ্ট্রনীতিরই ধারাবাহিকতা যুক্তরাষ্ট্রই কেবলমাত্র অন্য দেশের স্বার্থ নিরূপণ করতে পারে- ট্রাম্পের শাসনও এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তার পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের আদর্শিক অবস্থান থেকে সরে আসলেও এখনো ‘যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বের’ধারণা থেকে সরে আসতে পারেননি ট্রাম্প।
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করেছে। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া কোনো অসঙ্গতি নয় বরং বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। জো বাইডেনের সময়কার বৈশ্বিক নেতৃত্বের পুরনো ধাঁচ এখন ফিকে হয়ে গেছে। ট্রাম্পের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করলেও তা সংঘাত ও বিভ্রান্তি বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করেছে।
রাশিয়ার জন্য ট্রাম্পের এমন বাস্তবধর্মী অবস্থান সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটোই নিয়ে এসেছে। ট্রাম্পের বিশ্বায়নবিরোধী মনোভাব পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সমালোচনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সমস্যা সমাধানে নিরাসক্তি এখনো সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রাখছে। সরাসরি মুখোমুখি হতে না চাইলেও ট্রাম্পের স্বল্প-সময়ে অধিক প্রাপ্তির লোভ এবং সবকিছু একত্রে নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা আসন্ন সময়ে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
সব মিলিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে ট্রাম্পের ফেরা পরিবর্তনশীল বিশ্ব ব্যবস্থারই প্রতীক। যখন ঐতিহাসিক জোট এবং প্রতিষ্ঠানগুলো নড়বড়ে হয়ে পড়ছে তখন নতুন সব মাত্রা তৈরি হচ্ছে, যা জাতীয় স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল। এই পরিবর্তন স্থিতিশীলতা আনবে নাকি উত্তেজনা বাড়াবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত: পুরোনো ‘বিশ্ব নেতৃত্বের’ যুগ শেষ হয়েছে। ট্রাম্প তারই প্রতীক।
মূল লেখা: ফিওদর লুকিয়ানোভ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশিষ্ট রুশ বিশেষজ্ঞ। আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অসংখ্য প্রকাশনার লেখক। ২০০২ সাল থেকে তিনি রাশিয়া ইন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। এই ম্যাগাজিনটি বিদেশি এবং রুশ বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সংলাপ ও বিতর্কের একটি স্বনামধ্য প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
ভাষান্তর: সরকার জারিফ
লেখাটি রাশিয়ার Rossiyskaya Gazeta পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর এটি ইংরেজিতে সম্পাদনা করে আরটি টিম।