প্রবাসীর স্বজনদের বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ উদ্বোধন করার পরে, ড. ইউনূস স্যালুট দিয়েছিলন। প্রশ্ন হলো কাকে? কাদেরকে ভিআইপি সম্মান দেওয়ার ঘোষণা দিলেন? এমন প্রশ্ন সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে ছিল।
কারণ রাজনীতির নামে মানুষদেরকে কষ্ট দেওয়ার রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পতনের ৫ মাস পর বিমানবন্দরে এক প্রবাসী ভাইকে নির্মমভাবে নির্যাতিত হতে দেখেছে জনগণ।
৩৬ জুলাইর পরে গঠিত সরকারের শাসনামলে দেখেছে ছাত্র-যুব-জনতার বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসনে নীরবতা। একই সঙ্গে দেখেছে- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসী যাত্রী এবং তাদের স্বজনদের জন্য ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৪ নভেম্বর আজারবাইজান থেকে দেশে ফিরে প্রধান উপদেষ্টা এ লাউঞ্জ উদ্বোধন করেন। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে এমন নির্মমতা আমাদেরকে কেবল বাকরুদ্ধই করেনি, আতঙ্কিতও করেছে।
সৌদিপ্রবাসী জনৈক আইউব খান আমার সঙ্গে আলাপকালে বলছিলেন, ভাই যে কষ্ট করে টাকা উপার্জন করি, সেই কষ্টের কোনো দাম অতীত সরকার প্রবাসীদেরকে দেয়নি, এই সরকারের প্রত্যাশা রইল। বিমানবন্দরে হালার কি বিচার পাওয়া যাবে?
আইউব খানকে উত্তর দিতে পারিনি। কেননা, জানি না পরবর্তী সরকারেরও মুখে মধু অন্তরে বিষ থাকবে কি না? তবে বুঝতে পারছি ছাত্র-যুব-জনতার রক্ত-শ্রম-মেধা ও জীবনের কোনো ভালো ফল বাংলাদেশ পাচ্ছে না নিকট সময়ের মধ্যে। হয়তো এ কারণেই ওয়েটিং লাউঞ্জের উদ্বোধন করে বলা ড. ইউনূসের কথা বিপরীতে হাঁটছে।
তিনি বলেছিলন, আজারবাইজান যাবার পথে প্রবাসীদের জন্য বিমানবন্দরে একটি লাউঞ্জ উদ্বোধন করে গিয়েছিলাম। এ লাউঞ্জটা প্রবাসীদের জন্য ডেডিকেটেড, যাতে তাদের পথে পথে ঘুরতে না হয়।
বিদেশে যাওয়া এবং ফেরার সময় যেন তারা এটি আরামে ব্যবহার করতে পারেন। আর আজ প্রবাসীর স্বজনদের জন্য ওয়েটিং লাউঞ্জ উদ্বোধন করা হলো। শুধু কি এখানেই শেষ! প্রবাসীদের পরিবার-পরিজনের জন্য এর যাত্রা শুরু হলো উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা এই ওয়েটিং লাউঞ্জকে কীভাবে আরও স্বস্তিদায়ক করা যায়, সেজন্য প্রবাসীর স্বজনদের মতামত ও পরামর্শ দেওয়ার আহ্বান জানান।
তার চেষ্টার কোনো ত্রুটি না থাকলেও গত ৫৩ বছরের রাজনৈতিক সরকারগুলোর আশকারায় দানবের মতো হয়ে ওঠা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রতিটি নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নকর্মী যেন নীরব খাদকে পরিণত হয়েছে; সেই সঙ্গে তাদের সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতনরা রাক্ষসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
যে কারণে নিরাপত্তাকর্মীদের মারধরে রক্তাক্ত হওয়া প্রবাসীর কাছে ক্ষমা না চেয়ে, তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করার মতো গর্হিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতটাই মবের পথে হাঁটছে দেশ, যে যাত্রীর অপরাধের বিচারের রাস্তা তৈরি না করে অমানবিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত করা নরওয়ে থেকে আসা সেই প্রবাসীকে জরিমানা করতে সজাগ হয়ে ওঠে বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এর আগের ঘটনা, নরওয়েপ্রবাসী সাঈদ উদ্দিন বিমানবন্দরের ২ নম্বর ক্যানোপি গেট দিয়ে বেরিয়ে আসেন। গেট-সংলগ্ন ডান পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় এক এভসেক সদস্যের সঙ্গে তার কথা-কাটাকাটি হয়।
একপর্যায়ে ওই যাত্রী উত্তেজিত হয়ে ওই নিরাপত্তাকর্মীকে ধাক্কা দেন। এর পরপরই অন্যান্য এভসেক ও আনসার সদস্যরা সাঈদকে কনকর্স হলের দিকে নিয়ে যান। এ সময় সাত-আটজন মিলে তাাকে বেদম মারধর করেন। এতে সাঈদের মাথা-মুখ ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। সেখান থেকে সাঈদ বেরিয়ে এলে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে এভসেক সদস্যরা তাকেসহ তার আত্মীয়স্বজন সবাইকে আবারও ভেতরে নিয়ে যান। পরে গভীর রাতে তাকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিকে বিষয়টি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ চেপে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মারধরের শিকার যাত্রীর রক্তমাখা শরীর ও কিছু কথা-কাটাকাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিও দেখার পর এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ছাত্র-যুব-জনতা। তারা বিচার চাইলেও সেই দাবি পৌঁছেনি ৫৩ বছরের রাক্ষসের রামরাজত্ব বিমানবন্দরের কর্তাদের কানে। অথচ আমাদের কানে ভেসে আসছে আর্তনাদ, সেখানে মারধরের শিকার ব্যক্তিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আপনারা পাঁচ-ছয়জন ধরে আমাকে মারছেন।’
এখন কথা হলো আমাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধারা রিজার্ভ পরিপূরণকারী। তারা কখনো কোনো কিছু দাবি করেন না, এমন কর্মীদের সঙ্গে এত নির্দয় আচরণ করা হচ্ছে? কেন সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড (ডব্লিউইডব্লিউবি), জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) কর্মীদের এই সংকটের মুহূর্তে তাদের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না? প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণের জন্য। কিন্তু, তারা এ যাবত লজ্জাজনকভাবে নীরবতা পালন করে এসেছে।
তাদের কষ্টকথা কাউকে ষ্পর্শ করলেও আমাকে ছুঁয়ে গেছে ছাত্রজীবন থেকেই। যে কারণে লিখতে বাধ্য হচ্ছি- প্রতিটা প্রবাসী সোনার ডিমপাড়া রাজহাঁসের মতো। আমাদের কোনো সহায়তা ছাড়াই এবং আমাদের কাছ থেকে অবিরত অপমানের শিকার হয়েও তারা এই কাজটি বছরের পর বছর করে যাচ্ছেন।
২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে দেশের বাইরে থেকে আসা বাৎসরিক গড় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তা বেড়ে গিয়ে ২১ দশমিক সাত বিলিয়নে পৌঁছায়।
বিশ্বব্যাপী মহামারি, সার্বক্ষণিক চাকরি নিয়ে সমস্যা ও আর্থিক ক্ষতির মুখেও ২০২১ মালে ১৭ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছি। ২০২২ সালে এসে সেই রেমিট্যান্স বেড়ে ২২ বিলিয়ন, ২০২৩ সালে ২৫ বিলিয়ন, ২০২৪ সালের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়েও প্রায় ৪১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্সের সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ।
এই বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে সরকারকে একটি টাকাও খরচ করতে হয় না। কর্মীরাই সব খরচ বহন করেন।
একদিকে তারা সব ধরনের ফি এবং মাত্রাতিরিক্ত প্লেন ভাড়া বহন করেন, আর অপরদিকে আমরা এতটাই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার সুবিধা উপভোগ করছি যে, আমরা শ্রীলঙ্কাকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে সহায়তা করতে পারছি।
এমতাবস্থায় অন্ধকারের রাজনীতিকে না বলার মধ্য দিয়ে অর্জিত সরকারের সময়ে প্রবাসী ভাইয়ের ওপর হামলা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। তাই চাই- প্রবাসী ভাইয়ের ওপর হামলাকারী নিরাপত্তাকর্মীদেরকে বিচারের আওতায় আনা হোক।
এ কথাও সত্য যে, প্রবাসী কর্মীদের প্রতি সব সময়ই অবহেলা, নির্লিপ্ততা ও অসম্মান প্রদর্শন দেখতে পেয়েছে জাতি। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কার্যধারার নিরীক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। এ দাবি বাংলাদেশের সব মানুষের, বিশ্বের সব প্রবাসীর। তাদের কথা একটাই- অপরাধ করলে বিচার করুন, কিন্তু মবের শিকার করবেন না; আর আমাদের সঙ্গে মব যারা করেছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনুন।
লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক, চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি।